Wednesday, March 28, 2012

এসব কী চলছে ডিজিটাল দেশে?

শেখ হাসিনার বক্তৃতাটি শুনে চমকে উঠেছি! এশিয়া কাপের ফাইন্যালের দিন মাঠে যদি না যেতেন খালেদা জিয়া! এর আগে মোহাম্মদ নাসিমও রাবিশ বক্তব্য দিয়েছিলেন। গুরুত্ব পায়নি। শেখ হাসিনার বক্তব্যের পর সেটিকে গুরুত্ব দিতে হয়। কারণ তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশের বিরোধীদলের নেত্রী সম্পর্কে তিনি এমন আপত্তিকর বক্তব্য দিতে পারেন না। কারণ সাবজেক্টটা রাজনীতিও না। ক্রিকেটের। দেশের রাজনীতিকরা যা পারেন না, আজকাল ক্রিকেটাররা প্রায়ই তা করে দেখাচ্ছেন। দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করছেন প্রায়। এশিয়া কাপ ক্রিকেটকে কেন্দ্র করেও ব্যক্তিগত ও দলগত পারফরমেন্সে জাতীয় ক্রিকেটদল সেভাবে দেশকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। সে ঐক্যের আহবানে সাড়া দিয়ে বিরোধীদলের নেত্রী খালেদা জিয়াও স্বতঃস্ফূর্তভাবে মাঠে খেলা দেখতে গিয়েছিলেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন একটি সুযোগ মিস করেছেন। রাষ্ট্রপতির পাশে সেদিন বিরোধীদলীয় নেত্রীকেও খেলা দেখতে তাদের  পাশে ডেকে নিতে পারতেন। এটি করলে তাতে দেশের মানুষের কাছে তার বড় মনের পরিচয় মিলত। কিন্তু তিনি তা করেন নি। উল্টো বিরোধীদলের নেত্রীকে কটাক্ষ করে বলতে চেয়েছেন, তিনি খেলা দেখতে যাওয়াতেই দল হেরেছে! তা-ও এতে আবার এক্ষেত্রে তার গৃহপরিচারিকার বক্তব্যকে উদ্ধৃত করা হয়েছে! এটি আমাদের জাতীয় ক্রিকেটদলের পারফরমেন্স ও কৃতি্ত্বকে ছোট করা হয়েছে। একটি সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশের প্রধানমন্ত্রী, সংসদনেত্রী হিসাবে বিরোধীদলের নেত্রীকে তিনি এভাবে ছোট করতে, কটাক্ষ করতে পারেন না। এর মধ্য দিয়ে দেশের সংসদকেই ছোট ও কটাক্ষ করা হয়েছে, যা রীতিমতো বিপদজ্জনক।

একটা কথা মাঝে মাঝেই লিখি, শেখ হাসিনাকে এবার ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার সময় তার কথাবার্তার ফাইল একটু উল্টে দেখতে বলি। মানুষ সেসব বিনীত কথাবার্তা পছন্দ করেছিল। আজকের দুর্বিনীত কথাবার্তাকে অপছন্দ করছে। মনে করা হয়, এসব দুর্বিনীত কথাবার্তার কারণেই ১৯৯১ সালের নির্বাচনেও শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসতে পারেন নি।

চট্টগ্রামে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে খোদ বন ও পরিবেশমন্ত্রীর উদ্যোগে দুটি হাতিকে ব্যবহার করা হয়েছে! বার্তাটি মোটেই ডিজিটাল রুচির পরিচায়ক নয়। যে দেশকে ডিজিটাল হিসাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন স্লোগানে ক্ষমতায় আসা একটি দল যে দেশে দোয়েল ল্যাপটপের প্রোডাকশন্স-মার্কেটিং উদ্বোধন করে, সেদেশের প্রধানমন্ত্রীকে দেশের একটি অঞ্চলে বনের হাতি দিয়ে বরণ করা হয়! তাও আবার সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীর উদ্যোগে? বন্যপ্রাণীর ব্যবহার-অপব্যবহার নিয়ে আন্তর্জাতিক আইন-কানুনও জানেন না এই মন্ত্রী? পরিবেশ সচেতনতার বৈশ্বিক কর্মসূচির অংশ হিসাবে সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আলগোরের উদ্যোগে অ্যান্টার্কটিকা ঘুরে এসে এই জ্ঞান-সচেতনতাই কী হলো আমাদের ডিজিটাল সরকারের এই মন্ত্রীর? আমাদের শৈশবে ইবনে মিজান, এফ কবীর চৌধুরী, দেলোয়ার জাহান ঝন্টুদের কথিত সব ফোক-ফ্যান্টাসির পোশাকি ছবিতে আমরা রাজা-বাদশাদের কাল্পনিক গল্পের ছবিতে এসব হাতি-ঘোড়ার ব্যবহার দেখতাম। দুনিয়ার সঙ্গে দেশের মানুষের রূচি বদলের সঙ্গে সেইসব পোশাকি ছবির ধারাও হারিয়ে গেছে। আর আমাদের চলতি ডিজিটাল সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে চট্টগ্রামে অভ্যর্থনা জানাতে ডিজিটাল প্রযুক্তি বা দলের দীর্ঘদিনের মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ক্যারিশমাও আর কাজে লাগছে না? সেখানে দরকার হচ্ছে শান্তি রানী ও শেঠ বাহাদুর নামের সাফারি পার্কের দুটি হাতি’র? বার্তাটি ভালো হলো না প্রধানমন্ত্রী!

স্বাধীনতা দিবসে খালেদা জিয়াকে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে যেতে কেন বাধা হয়েছে? কেন বাধা দেয়া হয়েছে তার হোটেলের প্রোগ্রামে? এর আগে গত বিজয় দিবসেও খালেদা জিয়ার স্মৃতিসৌধে যাওয়া নিয়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মারপিট হয়েছে। এবার গুলশানের বাড়ি থেকে বেরুবার আগেই তার বহরের সামনে পুলিশ দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হলো কেন? এরপর পথে পথে দলীয় গুণ্ডাদের ব্যবহার করা হলো কেন? স্বাধীনতার বিদেশি বন্ধুরা ঢাকা এসে সরেজমিন কী দেখে গেলেন? সচিত্র সন্ধানী আর আশির দশকের যায়যায়দিনের শফিক রেহমান আজ কিসের আশায় কোথায় পোতায়া গেছেন, এটি তার নিজস্ব ব্যাপার। তার মেধা-প্রতিভা তিনি এখন বেগম জিয়ার জীবন গবেষণার নামে টাকা কামাই আর সাংবাদিক ঠকানোয় নিয়োজিত করেছেন, এটি তার ব্যাপার।

আব্দুল গাফফার চৌধুরীর তো একটি মাস্টার পিস ‘আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো’ গান আছে; এটি ছাড়া বাঙ্গালির একুশে ফেব্রুয়ারি পালন করা হয় না। কিন্তু তার (শফিক রেহমানের)সর্বশেষ দেশের শতশত সাংবাদিক ঠকানো ছাড়া কী কীর্তি আছে? দেশের সাংবাদিকরা কী কোনোদিন বিমানবন্দরে শফিক রেহমানের মতো আব্দুল গাফফার চৌধুরীর গতিরোধ করেছেন? সেই শফিক রেহমানের খালেদা জিয়ার জীবনীগ্রন্থ প্রকাশ অনুষ্ঠানে বাধা দিতে গিয়ে তাকে যে আব্দুল গাফফার চৌধুরীদের আক্রমণের সুযোগ করে দেয়া হলো, এর দায়দায়িত্ব কে নেবে? পচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে খুনের মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটানো হয়। এখন বই প্রকাশ বাধাগ্রস্ত হবার পর শফিক রেহমান বলেছেন, আরও খারাপ ভাবে খুন হবেন শেখ হাসিনা! আরও খারাপভাবে বিদায় হবে শেখ হাসিনার সরকারের! আমাদের প্রিয় শফিক ভাই কী এসব পরিকল্পনা আপটুডেট ভালো জানেন, নাকি শ্যাম্পেন একটু বেশি পড়েছিল পেটে? এসব ঘটনা কেন ঘটানো হলো এর সাফ জবাব দিতে হবে সরকারকে। এসব এনালগি আচরণ কিন্তু কোনো ডিজিটাল সরকারের নমুনা নয়। 

Sunday, March 25, 2012

টিপাই বাঁধের পক্ষে দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাইকমিশনারের সাফাই

ভারতের উত্তরপূর্বের মনিপুর ও মিজোরাম রাজ্যের সীমান্তের বরাক ও তুইপাই নদীর মুখে প্রস্তাবিত টিপাইমুখ প্রকল্প বাংলাদেশের জন্য উপকারই হবে বলে মন্তব্য করেছেন ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারিক আহমেদ করিম।

স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ভারতের সংবাদমাধ্যমের জন্য রোববার পাঠানো একটি প্রবন্ধে হাইকমিশনার এ মন্তব্য করেছেন।

কলকাতার বহুল প্রচারিত বাংলা সংবাদপত্র ‘দৈনিক প্রয়াগ’র প্রধান প্রতিবেদক দীপন বন্দোপাধ্যায় হাইকমিশনারের প্রবন্ধটি সম্পর্কে রোববার সন্ধ্যায় বাংলানিউজকে জানান।

নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার এনামুল হক চৌধুরী হাইকমিশনারের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটি প্রবন্ধ লেখার বিষয়টি বাংলানিউজের কাছে নিশ্চিত করেন।

‘বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক : এগিয়ে যেতে আমার ভাবনা’ শীর্ষক শিরোনামে ওই প্রবন্ধটিতে হাইকমিশনার লিখেছেন, ‘টিপাইমুখ প্রকল্প আকস্মিভাবে (ক্যাটালিজম) কোনও ক্ষতি করবে না, এটা বাংলাদেশের উপকার করবে।’ 
 
নয়াদিল্লি থেকে প্রেস মিনিস্টার এনামুল বলেন, ‘রোববার সকালে আমি হাইকমিশনারের প্রবন্ধটি ভারতের সংবাদমাধ্যমে পাঠিয়েছি।’

টিপাইমুখ বাঁধ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শনিবার সিলেটে আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে জনসভায় বলেছেন, ‘বাংলাদেশের কোনো ক্ষতি হলে টিপাইমুখে বাঁধ করতে দেওয়া হবে না।’

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পরদিনই নয়াদিল্লিস্থ বাংলাদেশের হাইকমিশনার বাঁধ নিয়ে এই মন্তব্যে ভারতের গণমাধ্যমগুলোতে ব্যাপক আগ্রহের জন্ম দিয়েছে।

আসামের বাংলা সংবাদপত্র দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুর আহমেদ বড়ভূঁইয়া রোববার টেলিফোনে বাংলানিউজের কাছে হাইকমিশনারের লেখা সম্পর্কে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘এটা খুবই আগ্রহোদ্দীপক বিষয়, যে হাইকমিশনার বিষয়টি কিভাবে দেখছেন।’

মনজুর বলেন, ‘টিপাইমুখ বাঁধের বিরোধিতা শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং আসামের বরাক উপত্যকার মানুষ এবং খোদ মনিপুর রাজ্যেও হচ্ছে।’

হাইকমিশনার যা লিখেছেন:

‘বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া রিলেশন: মাই ভিশন অব দ্য ওয়ে ফরওয়ার্ড’ শিরোনামের প্রবন্ধে তারিক আহমেদ করিম বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন।

টিপাইমুখ বাঁধ প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘অনেকেই টিপাইমুখ প্রকল্প নিয়ে বিরোধিতা করছেন, কিন্তু আমি মনে করি এই প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে আকস্মিকভাবে কোনো ক্ষতি হবে না, বরং এই প্রকল্প থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ পেতে পারে।’

তিনি আরো লেখেন, ‘টিপাইমুখ হবে একটি জলবিদ্যুৎ বাঁধ, যেখানে একটি নির্দিষ্ট মাপ পর্যন্ত পানি জমা করা হবে এবং পরে সেখান থেকে পানি বেরিয়ে আসবে যা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে।’

বাঁধ প্রসঙ্গে বিরোধিতাকারীদের বিরোধিতা করে বাংলাদেশের হাইকমিশনার বলেন, ‘বরাক নদীসহ কোনো নদী দিয়েই পানি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়া হবে না বা কোনো পানি প্রত্যাহারও করা হবে না।’
 
তিনি আরো বলেন, ‘শুধু জলবিদ্যুৎই উৎপাদনই নয়, এই প্রকল্প থেকে বন্যাও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’

তবে হাইকমিশনার এই প্রকল্পে যৌথ সমীক্ষার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বলেন, ‘একটি যৌথ সমীক্ষা হলেই সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে এবং সবাইকে শান্ত করা যাবে।’ 


Sunday, March 18, 2012

রুনী-সাগর হত্যাকাণ্ড: আদৌ কি তদন্ত চলছে?

১১ ফেব্রুয়ারী, সকাল আটটা। ঘুমের মধ্যেই ফোনটি ধরলাম। অপর প্রান্ত থেকে খুব চেনা একটি কন্ঠস্বর বললো, ‘শুনছেন, সাগর রুনি দুজনই আত্মহত্যা করছে কিংবা ডাকাতি হইছে। 
 
কিছু জানেন নাকি?’ মুহুর্তে চিত্কার করে উঠে বসলাম। ‘প্রভাষ দা? বুঝলাম না আপনার কথা।’ এটিএন নিউজের প্রধান বার্তা সম্পাদক প্রভাষ আমীন যা বললেন, তা এমন: মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি-এরা দুজনই মারা গেছেন। তবে সেটি আত্মহত্যা নাকি ডাকাতি নিশ্চিত নয়। আমি অবিশ্বাসের সুরে বললাম, ‘খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি।’ রুনির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বলে পরিচত এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি নাদিরা কিরনকে ফোন করলাম। ধরা গলায় কিরন আপা বলেলন, ”সব শেষ!” আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। বাসা থেকে বের হতে হতে আমার অফিস মাছরাঙার প্রধান বার্তা সম্পাদক রেজওয়ান হক রাজা ভাইকে ফোন করলাম এবং খবরটা নিশ্চিত করলাম।

সম্ভবত দশটা বেজে গেলো পশ্চিম রাজা বাজার পৌছাতে। ওই গলিতে ঢোকার পথে দেখলাম, ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের একটি গাড়িতে করে মেঘকে কোথা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর উল্টোদিক থেকে প্রবেশ করছে সিআইডি’র ’ক্রাইম সিন’ গাড়ি। আমি বিনা বাধায় রুনি সাগরের পাঁচতলার ফ্লাটে উঠলাম। সেখানে তখন গমাধ্যমকর্মী, পুলিশ এবং রুনি সাগরের অল্প সংখ্যক আত্মী-স্বজনে ঠাসা। সবার চোখে অবিশ্বাস, যেনো যা ঘটেছে তা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছেনা কারো! যে রুমে হত্যাকান্ড হয়েছে সেই বেড রুমটি বন্ধ, ভেতরে পুলিশ কর্মর্তারা। রুনি সাগরের মৃতদেহ তখনো সেখানে। আলামত সংরক্ষন হচ্ছে। ওই রুমের সামনেই ডাইনিং স্পেসটিসহ রুমটি সিআইডি’র ক্রাইম সিন জোন’ ফিতা লাগানো। তাই শত চেষ্টা করেও দেখতে পারিনি ভেতরের অবস্থা। এরই মধ্যে একজন বললেন, রান্না ঘরের গ্রিলটি কাটা। আরেকজন বললেন, ওখান দিয়ে ছোট বাচ্চা ঢুকতে পারবে না। ‘মনে হয় আগে ছোট বাচ্চা ঢুকিয়ে দিয়ে ঘরের দরজা খুলেছে।’ উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিকের এসব মন্তব্য শুনতে শুনতে আমি রান্না ঘরে গেলাম, সেখানে তখন সিআইডি’র বহুল আলোচিত কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আখন্দ। তাকে ওই কাটা অংশটি দেখিয়ে সাদা পোষাকের এক কর্মকর্তা বললেন, এখান থেকে কিভাবে ঢুকবে? কাহার আখন্দ কাটা অংশটি মনোযোগ দিয়ে দেখলেন, গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে নিচে কিছু দেখতে চাইলেন। তার মনোভাব বোঝা গেলোনা। আমি জানতে চাইলাম, তিনি মাথা নাড়তে নাড়তে ’দেখি’ বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি গ্রিলের কাটা অংশটি দেখলাম, ভালো করে। আটি ইঞ্চি মতো বর্গাকার ফাঁকা দিয়ে কোন্ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পক্ষে প্রবেশ করা সম্ভব কি না অনুমান করতে পারলাম না। মাথাই ঢুকবেনা’ কানে আসলো এক সহকর্মীর মন্তব্য। আমি চুলার দিকে তাকালাম। শূন্য দুই চুলার মাঝখানে একটি ফ্রাইপ্যান, দুটি ডিমের খোসা, অগোছালো টুকটাক জিনিসপত্র, ছড়ানো ছিটানো।

পরের দিন মেঘের কাছে শুনেছি, ‘দুইটা চোল (চোর) আমার ডিম খেয়ে ফেলছে। তিনটা ডিম ছিলো। আমার বাবাকে মেরেছে। আমাকে গুলি করতে চেয়েছিলো। গুলির মধ্যে ব্যাটারি লাগানো তাতে ছোট লাইট জ্বলছে ।” মেঘের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার একবারই কথা হয়েছে, এবং তা দিয়ে একটি নিছক মানবিক আবেদনময়ী রিপোর্ট প্রচাররিত হয় মাছরাঙা টেলিভিশনে।সেই রিপোর্টের কারনে আমি অনেক সমালোচিত হয়েছি। মেঘের ওই মানসিক অবস্থায় বাবা-মার মৃত্যু নিয়ে কথা বলা কতটা সঠিক ছিলো সেই বিতর্কে যাবোনা; তবে সব সমালোচনা মাথা পেতে নিয়েছি। মেঘ শিশুসুলভ এলোমেলো ভাবে বারবারই বলেছে, চোর ওর বাবাকে মেরেছে।মাকে আগে মেরেছে, পরে বাবাকে মেরেছে। রান্না ঘর থেকে চলে গেছে। নানুকে ফোন করে বলেছি, মিম্মি (মা)বাবা মরে গেছে।” আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ওদেরকে চেনো? মেঘ না বোধক মাথা নেড়েছে, মুখে বলেছে, ‘ওদের নামটা জানিনা’।

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সিড়িতে হতবিহ্বল সহকর্মীদের পাশে এসে দাড়ালাম। মনের ভেতর অনেক ভাঙ্গচুর, অসংখ্য প্রশ্ন। দু’টি জ্বলজ্যান্ত মানুষ ভেতরে মরে পড়ে আছে, কিন্তু কেউই বলতে পারছে না ঠিক কী ঘটেছে সেখানে। কানে আসতে লাগলো মৃদু গুঞ্জন। মেঘ নাকি কাকে বলেছে, ওদেরকে পিকনিকে দেখেছে . . . রুনি-সাগর ভাইয়ের কোন্ও শত্রু থাকতে পারে, এটাই বিশ্বাস করা যায়না, সেখানে এতো বড় চেনাজানা শত্রু যারা, তারা এতোটা নির্মম-নৃশংসভাবে হত্যা করবে!.কিছুই মাথায় আসেনা।

শূন্যতায় হাতড়াচ্ছি, এমন সময় দেখলাম সাগর সরোয়ারের আম্মা এবং বোন ‘আমার বাবু’ আমার সাগর রুনি’ বলে কাঁদতে কাঁদতে চারতলা সিড়ি দিয়ে উঠছেন। সাগর ভাইয়ের আম্মাকে ধরে নিয়ে গেলাম ভেতরে, রান্না ঘর লাগোয়া একটি রুমে, সম্ভবত রিডিং রুম। কিছুটা ফাঁকা ওই রুমে একটি টেবিল, বুকসেলফ—তবে কোনও চেয়ার ছিল না। কিছুক্ষন পরই সেখানে এলেন ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ। সাগর ভাইয়ের আম্মা তাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, আমার একটাই ছেলে, আমার এইটাই বাবু. পুলিশ কমিশনারের মুখে কোন্ও কথা ছিলোনা। ‘আমরা দেখছি, আমরা দেখছি’ বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। ঢুকলেন রুনির আম্মা। তাকে আগেই দেখেছিলাম, বসার ঘরে, ঘটনার আকস্মিকতায় তার চেহারায় ফুটেছিলো ভাবলেশ-বোধহীন গভীর শূন্যতা। জিজ্ঞেস করলাম, কি ঘটতে পারে?কিছু জানেন কিনা? কিছুটা অস্পষ্ট এবং স্বভাবসুলভ দ্রুতিগতিতে যা বললেন, তার ভাবার্থ: তিনি কিছুই বুঝতে পারছেননা। কখন কিভাবে খবর পেলেন? বললেন, সকাল সাতটার দিকে মেঘ তাকে ফোন করে। কিন্তু লাইনটি কেটে যায়। তিনি কলব্যাক করলে মেঘ ফোন ধরে জানায়, আম্মা, (মেঘ নানীকে আম্মা ডাকে) বাবা মা দুজনই মরে গেছে। মেঘের কন্ঠস্বর তার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। ছুটে আসেন ‍রুনির ফ্লাটে, দরজা খুলে দেয় মেঘ। পরের দিন মেঘ আমাকে বলেছে, সে নিজেই দরজা খুলেছে। চোর যায়ার পর কি তুমি দরোজা বন্ধ করেছিলে? মেঘ বলেছে, ওরা জানালা ভেঙ্গে ফেলেছে।

রুনির আম্মার সঙ্গে কথা শেষ করে এসে দাড়ালাম ‘ক্রাইম সিন জোন’ ফিতার সামনে। ফিতার ওপারে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাদা পোষাকের লোকজন। এপারে সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা।তখন সম্ভবত বেলা সাড়ে এগারোটা কি বারোটা হবে। হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার রুমে তখনো পুলিশ। ফিতার ওপারে যাওয়ার একটু চেষ্টা করলাম, পুলিশের অনুরোধে ফিরে এলাম। এখন যখন পুলিশ আলামত নষ্ট হওয়ার কথা বলে, ভেবে পাইনা, পুলিশ তখন অতো দীর্ঘ সময় ভেতরে কি করেছিলো? পুলিশের উচু পদস্থ, অ-পদস্থ কমবেশি সবাই ওই রুমে ঢুকেছেন, কোনও গমাধ্যমকর্মীকে আমি ভেতরে ঢুকতে দেখিনি। এমনকি সাগর রুনির মৃতদেহ’র ফুটেজ মাছরাঙাসহ কয়েকটি চ্যানেল সবার আগে পৌছানো দু’ একটি চ্যানেল থেকে সংগ্রহ করেছিলো। আমি সেই ফুটেজেই দেখেছি ওই রুমের অবস্থা। হাত পা বাধা সাগর ভাই, আর বিছানা ঘেঁষে একটু বেকে থাকা রুনির মৃতদেহ। ওই ফুটেজটি ভালো করে দেখলে বোঝা যায় সেটি দরজার সামনে থেকে তোলা। 

পুলিশ সম্ভবত আটটা সোয়া আটটা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌছায় রুনীর ভাই ন্ওশের রোমানও তখনই পৌছায়। রোমান বলেছে, সে ও ওই রুমে ঢোকেনি। এমনকি ততক্ষনাত ঘটনাস্থলে পৌছানো কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা দরজার সামনে থেকে দেখেছেন, ভেতরে প্রবেশ করেননি। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে আলামত নষ্ট হলো কি করে? করলোইবা কে? আলামতের কয়েকটি মৌলিক বিষয় রয়েছে, ‘সাধারন মানুষ কখনো রক্তের ওপর পা রাখেনা। কিন্তু খুনী রক্তের ওপর তার ছাপ রেখেই যায়, কেনো যেনো খেয়াল করতে পারেনা,’ নিজের ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে কথাটি বলছিলেন সিআইডির সাবেক কর্মকর্তা খালেকুজ্জামান, পিপিএম। তিনি বলছিলেন, ‘পুলিশ কি আলামত চায়? এখন তো রিকসা ওয়ালাও স্যান্ডেল পরে। ধরে নিতে পারি খুনি জুতা পরেছিলো, তাই ফুটপ্রিন্ট পাওয়া যাবেনা ঘটনার দুদিন পর কথা হয়েছিলো খালেকুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি আরও বলেন, ‘হত্যাকারীরা পেশাদার ভাড়াটে খুনী, তা না হলে শিশুটিকে হত্যা করতো। সাধারন মানুষ হলে শিশুটি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ভেবে ভয় পেয়ে হত্যা করতো। তাহলে এই হত্যাকাণ্ডের মটিভ কী হতে পারে- এর জাবাবে খালেকুজ্জামান পাল্টা প্রশ্ন করেন,
ওই বাসার দুটি ল্যাপটপের একটি নষ্ট, সেটি রেখে গিয়ে খুনী ভালোটি নিয়ে গেলো, কেন? তারা চেক করলো কখন? চোর ডাকাতদের তো এতো সময় থাকার কথা নয়!

চোর ডাকাত কি ল্যাপটপ নিতে পারেনা? 

পারে, তবে সেক্ষেত্রে তারা দু’টোই নিতো।

সাগোর সরোয়ারের দুটি মোবাইল ফোনের মধ্যে ব্যক্তিগত মোবাইলটি নিয়ে গেলো, অফিসেরটিসহ রুনির মোবাইলও রেখে গেলো, কেন?

চাঞ্চল্যকর অনেক হত্যা রহস্যের জট খোলা এই গোয়েন্দা নিজেই প্রশ্ন করেন, নিজেই জবাব দেন খুনীদের আক্রোশ সাগরের ওপর, যে কারনে তাকে এতো আঘাত করা হয়েছে, হাতপা বেধে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে, তারা যা চায় তা তার ল্যাপটপে সংরক্ষিত থাকতে পারে
 
ফিরে আসি ঘটনার দিনে। ক্রাইম সিন জোন ফিতা থেকে নিজেকে সরিয়ে আবার ফিরে এলাম সিড়িতে। কেউ একজন কানের কাছে ফিসফিস করলো, রুনির ভাইকে এরেষ্ট করেছে।’ পরে শুনেছি, ওকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ডেকেছিলো, ছেড়েও দিয়েছে।আমি সিড়ি বেয়ে একেবারে নিচে নিমে এলাম। পার্কিং এ দাড়ালাম সাবেক কয়েকজন সিনিয়র সহকর্মীর সঙ্গে। হঠাত দেখি বিভিন্ন চ্যানেলের রিপোর্টার ঘিরে ধরেছে ডিসি সাউথ ইমাম হোসেনকে। সেদিন আমি কোন্ও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে যাই নি। তবু এগিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ‘প্রাথমিক ভাবে ধারনা করা হচ্ছে হত্যাকারীরা পূর্ব পরিচিত’।
 
পুরনো সহকর্মীদের কাছে আবার ফিরে এলাম। সবর্ত্র তখন জ্বল্পনা-কল্পনা। রোপিত হচ্ছে গুজবের বীজ।

তখন সম্ভবত দেড়টা, ময়না তদন্তের জন্য সাদা প্যাকেটে মোড়ানো সাগর ভাই রুনিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। ঝাপসা চোখে স্লাইড শো’র মতো ভেসে ভেসে উঠলো রুনী সাগর ভাইয়ের স্মৃতি।যতবার মেঘের কথা ভাবি, মেঘের চেহারা ছাপিয়ে চোখে ভেসে ওঠে সমবয়সী আমার ছেলেটির মুখ। শূন্যতায় ভর করে ফিরে আসি বাসায়। একটু দম নিতে। আমার সন্তানটিকে একটু বুকে জড়িয়ে ধরতে। চারটার দিকে গেলাম আমার অফিসে। অনুরোধ আর নিজের চেষ্টা সত্ত্বেও আমি কোনও রিপোর্ট বানাতে পারলাম না। নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, ওইদিন বুঝলাম, যতটা পেশাদার নিজেকে মনে করি, ততটা আমি নই।

সন্ধ্যার পর থেকে একটু পরপরই আমার মোবাইলটি বেজে ওঠে। গমাধ্যমকর্মীদের জড়িয়ে গুজব ছড়াতে থাকে। এখন এর নাম তো, একটু পর আরেকজনের নাম। সেই নামগুলোর মানুষরা এমন নৃশংশ ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকতে পারে, তা কল্পনায়ও আনা যায়না। নাম গুলো এসেছে ‘হত্যাকারীরা পূর্ব পরিচিত’ পুলিশের এই মন্তব্যের সঙ্গে সামর্থিক ভাবে মেঘের বক্তব্য ‘ওদেরেকে পিকনিকে দেখেছি’। তবে জিজ্ঞাসা সত্ত্বেও মেঘ আমাকে এমন কোনও কথা বলেনি।

সারারাত ঘুমোতে পারিনি। সকালে বের হলাম হত্যাকাণ্ডের ফলোআপ রিপোর্ট করতে। তখন সম্ভবত সকালে সাড়ে নটা। রুনি সাগর ভাইয়ের পাঁচতলা ফ্লাটে ঢুকতে ঢুকতে কানে এলো একটি কন্ঠস্বর, ‘চল্লিশ সেকেন্ড কথা বলে ফোনটা ওখানেই রেখে দেয়াটা অস্বাভাবিক’, নিজেরা নিজেরা কথা বলছিলেন পুলিশের একজন আরেকজনের সাথে। পরে বুঝলাম কন্ঠস্বরটি ছিলো ডিসি সাউথ ইমাম হোসেনের। সঙ্গে ছিলেন দুজন সিআইডি কর্মকর্তা, শের--বাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং আরও দু’ জন। তারা আমার সঙ্গে কোন কথাই বলতে চাইলেননা। অভিযোগ তুললেন, সাংবাদিকদের জন্য তাদের কাজে ধীরগতি হচ্ছে

আমি ফ্লাট থেকে বেরিয়ে সিড়িতে দাড়ালাম। কী করবো ভাবছি। এরইমধ্যে মেঘকে নিয়ে এলো রুনির তিন ভাই ও আম্মা। তখনই কথা হলো মেঘের সঙ্গে। জানলাম, মেঘ সারারাত ঘুমায়নি। অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কথা বলছে এলোমেলো।’ যা ছিলো ওই দিনের রিপোর্টের হেড লাইন।ওই দিনই মেঘের সঙ্গে দেখা করতে আসেন ওর স্কুলের শিক্ষকরা। এডিট প্যানেলে বসে মেঘের একটি শব্দ কানে লাগে। বারবার ফুটেজটি রিপিট করে দেখি। অস্পষ্টভাবে মেঘ ওর শিক্ষককে বলছে গলায় অনেক ব্যাথা। পরে মেঘের গলার ছবিটি ভালো করে দেখি। সেখানে গভীর কালশিটে দাগ। নখ বসানো। ফোন করি রোমানকে। জানলাম, খুনীরা মেঘকেও নির্যাতন করেছে, তার টুটি চেপে ধরেছে। চুল টেনেছে এবং পুরুষাঙ্গে আঘাত করেছে। খুনীদের একজনের হাতের নখ বড় বড় যার দাগ বসে আছে মেঘের গলায়।

১২ এবং ১৩ ফেব্রুয়ারী সাংবাদিকদের জড়িয়ে শুরু হলো গুজবের উন্মাদনা। এমনকি রুনির পরকিয়া প্রেমের গালগল্প। আমি মেলাতে পারিনা। কারন রুনিকে নিয়ে কোনদিন এমন ’গসিপ’ কখনোই শুনিনি। তাছাড়া অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনও ঘটনার কুলকিনারা না পেলে পুলিশ পরকিয়া প্রেমের গল্প ফাদে। আর এতো আপত্য প্রেম যে দুজনকেই মেরে ফেলতে হবে! অযৌক্তিক লাগে। কিন্তু কেউ কাউকে অকারনে হত্যা করেনা, তা ও আবার পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনে অভ্যস্ত এমন অমায়িক দুজন মানুষকে! এরইমধ্যে জানলাম সাগর ভাইয়ের একটি বইয়ের কথা, ‘কর্ণেলকে আমি মনে রেখেছি’। বইটি গত বছর বই মেলায় প্রকাশ করে ভাষাচিত্র। বইটি সংগ্রহ করে পড়লাম। শান্তিচুক্তির পর পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে লেখা অত্যন্ত স্পর্শ কাতর বইটি। এতে উঠে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে কারা সমস্যা জিইয়ে রেখেছে, কারা তাদের অর্থ ও অস্ত্র দেয়-এমন তথ্য। এসব বিষয়ের দু একটি অংশ এখানে তুলে ধরছি: 

কলিমুল্লার (রহিঙ্গা গেরিলা নেতা) কোমরে একটি পিস্তল। ছোটখাট ছিমছাম। আমার তাকানোর ভঙ্গি দেখে সে বুঝে নিলো প্রশ্ন। বললো,

এটি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া। গিফট। 

কোন সেনাবাহিনী?

বুঝে নিন।

আমি বুঝতে পালাম। অনেক কিছুই আমাকে বুঝে নিতে হয়। 

আপনারা কি ধরনের অস্ত্র পান?

যখন যে ধরনের অস্ত্র প্রয়োজন। 

চাইলেই পান?

চাইলেই পাই। যখন প্রয়োজন খবর দেই। জায়গা ঠিক থাকে। ওখানে রেখে দেয়া হয়। গুনে নেই, ‍গুনে দেই। তবে গুলির কোন হিসাব থাকেনা। 

যোগাযোগ কি করে হয়?

ওয়ারলেস। আমরা এমন একটি ফ্রিকোন্সে ব্যবহার করি যা কেউ জানেনা।

মানে সেনাবাহিনী্ও না?

বাবা তো ছেলের জন্ম তারিখ ঠিকই জানে, তাইনা!

উত্তর পেয়ে গেলাম।

ওই রিপোর্টের শিরোনাম দিলাম-সেনা সহায়তায় মিয়ানমারের গেরিলারা বাংলাদেশে।

আমার এক সোর্সকে কয়েকদিন আগে জীবন দিতে হয়েছে। তিনি কোন দলে ছিলেন জানিনা। তবে তাকে বাচিয়ে রাখাটা তিনপক্ষের জন্যই ছিলো বেশ ঝুকিপূর্ন। সব খবর তার কাছে আপনাআপনি চলে আসতো। কেবল আসেনি তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনার খবরটি

মূলত: ৭১ পৃষ্ঠার এই বইটিতে সাগর সরোয়ার অনেক চিঠিপত্র, ডায়েরির উল্লেখ করেছেন- যা তার কাছে সংরক্ষিত আছে,সহকর্মী শামীম আরা শিউলিকে বইয়ের একটি কপি সাগর ভাই উপহার দেয়ার সময় এমন তথ্য শেয়ার করেন। সেই সূত্র ধরেই অনেক অজানা তথ্য উপাত্ত এবং নথিপত্র তার সংগ্রহে থাকার কথা-জানিয়েছেন শিউলি
 
হত্যা রহস্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানলাম, সাগর ভাই একই ইস্যুতে আরেকটি বই লিখছিলেন যা এ বছর বইমেলায় প্রকাশ হওয়ার কথা। এরজন্য তিনি অফিসে ছুটি চেয়েছিলেন। কিন্তু লোকবলের অভাবের কারনে মাছরাঙা তাকে ছুটি দিতে পারেনি। বইটি সম্পর্কে মাছরাঙার স্টাফ রিপোর্টার মাযহার মিলনকে সাগর ভাই বলেছেন, এবার বোমা ফাটাবো। তখন জানবে সাগর সরোয়ার কী জানে আর কী লিখতে পারে

ধারনা করছি, ল্যাপটপেই থাকার কথা তার ওই বইয়ের পান্ডুলিপি।

প্রশ্ন জাগে, যে বইটি তিনি মাত্র গত বছরই মেলায় এনেছেন, তার দ্বিতীয় পর্ব লেখার প্রয়োজন হল কেন? তার কাছে কি নতুন কোনও তথ্য ছিলো? কি হতে পারে তা? তা কি কাউকে সংক্ষুব্দ করতে পারে? উত্তর জানা নেই।তবে পাহাড়ে ছিলো সাগর সরোয়ারের দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্ত সোর্স। রিপোটিং ছেড়ে দিলেও সাগোর ভাই সেই সম্পর্কগুলো মেইনটেইন করতেন।

পুলিশ বা তদন্ত কর্মকর্তারা এই দিকে কতটা নজর দিয়েছেন, আমার সন্দেহ আছে। কারন আমি নিজে কয়েকদফা এ বিষয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। উত্তর পেয়েছি দায়সারা গোছের। এমনকি পান্ডুলিপিটি উদ্ধারের জন্য তার ইমেইল এড্রেস এ খোজ করা হয়েছে কিনা, তেমন সদুত্তর পাইনি।

পুলিশ এখন ঘটনাটিকে ‌‌ডাকাতি’ হিসাবে দেখাতে সব ব্যবস্থা প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছে। যদি পুলিশের কথা বিশ্বাস করি, তবে তাদের দক্ষতা নিয়ে শুধূ প্রশ্ন নয়, পুলিশের ‘প’ জানেন কিনা সন্দেহ জাগতে পারে। কারন ঘটনার দিন আব্দুল কাহার আখন্দসহ বাঘা বাঘা কর্মকর্তারা দীর্ঘ সময় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কী বুঝেছিলেন? আমার মনে আছে, তিন দিন পর রুনির আম্মাকে ডেকে পাঠানো হয় বাসা থেকে কিছু খোয়া গেছে কিনা জানতে। তখনই জানা গেলো রুনির গয়না নেই। ঘটনার দশ দিন পর পুলিশ ওই পরিবারের কাছে জানতে চেয়েছিলো, সাগর সরোয়ারের ল্যাপটপের রঙ। ঘটনার দিন থেকে যেসব গুজব বেরিয়েছে তা সাংবাদিকরা ছড়িয়েছে সত্য, তবে প্রতিটি গুজবের পেছনে রয়েছে কখনো পুলিশের ইঙ্গিত, কখনো তাদের রহস্যময় নিরবতা। এসব কিসের ইঙ্গিত? তাদের অদক্ষতার? নাকি ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চক্রান্ত?

 

Wednesday, March 7, 2012

সাগর-রুনিকে দ্বিতীয়বার খুন

ফ্যাসিবাদী সরকারের চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গত তিন বছরে গণমাধ্যমকে তার অন্যতম প্রতিপক্ষরূপে বিবেচনা করেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার হেন অপচেষ্টা নেই, যা ক্ষমতাসীন মহল এই সময়ের মধ্যে গ্রহণ করেনি। বিজ্ঞাপন বন্ধ, টেলিভিশনে কালো তালিকা প্রণয়ন, সরকারি দলের চেলা-চামুণ্ডাদের হুমকি—এসব পন্থা মাত্রাভেদে সব সরকারই বিভিন্ন সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যবহার করেছে। তবে দিনবদলের সরকার যে ভিন্নমত দমনের জন্য অন্য প্রকারের ভয়ঙ্কর চণ্ডনীতি ব্যবহার করবে, সেটা বোঝা গিয়েছিল ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের প্রতিক্রিয়া থেকে। পেশাদার কিংবা ‘চান্স’ নির্বিশেষে পত্রিকার সম্পাদকদের ধরে ধরে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বর্বর নজির সৃষ্টিতে বর্তমান ক্ষমতাসীন মহল সভ্যতা-ভব্যতা, রীতি-নীতি, আইন-কানুনের কোনোরকম তোয়াক্কা করেনি।

সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ পেশাদার সম্পাদক এবং নির্ভেজাল ভালোমানুষ দৈনিক সংগ্রামের আবুল আসাদের দুর্বল শরীরের দিকে তাকিয়েও পুলিশের অন্যায় ও আইন বহির্ভূত রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করতে ‘স্বাধীন’ আদালতের মধ্যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা লক্ষ্য করা যায়নি! প্রথম আলোর প্রভাবশালী সম্পাদক মতিউর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী রীতিমত সংবাদ সম্মেলন ডেকে যখন ইচ্ছা গ্রেফতারের হুমকি দিয়েছেন। মার্কিন দূতাবাসের সরাসরি হস্তক্ষেপে সেই বিশিষ্ট সুশীল(?) সম্পাদক আমার ও আসাদ ভাই-এর ভাগ্য বরণ করা থেকে সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলেন। শীর্ষ কাগজের সম্পাদক একরামুল হককে রিমান্ডে নিয়ে তার পত্রিকা বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। আমার বিষয় নিয়ে দেশে-বিদেশে এত বেশি আলোচনা হয়েছে যে, সেগুলোর পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। মোট কথা, পত্রিকা সম্পাদক নামক ইনস্টিটিউশনটিকে অমর্যাদা করা বর্তমান সরকারের আমলে ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। অথচ ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিউটের (আইপিআই) নির্বাহী পরিচালক আলিসন বেথেল ম্যাকেঞ্জি তার বাংলাদেশ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কী অম্লান বদনেই না দাবি করলেন যে, তার আমলে নাকি সরকার কোনো সম্পাদকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করেনি! সেদিন তিনি বলেছেন, যে মামলাগুলো হয়েছে বা হচ্ছে তার সবই সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের দায়েরকৃত মানহানি মামলা। প্রধানমন্ত্রীর আসনে থেকে অসত্য ভাষণ সেই আসনের জন্য যে বিশ্রী রকমের অমর্যাদাকর একথার সঙ্গে আশা করি, সব পাঠক একমত হবেন।

আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা রেকর্ড সংখ্যক ৫৩টি মামলার মধ্যে অন্তত পাঁচটির বাদী সরকার নিজে এবং বাকি মামলাগুলোও সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও সরকারি দলের নেতারা করেছেন। সরকারি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা, রাষ্ট্রদ্রোহ, ইসলামী জঙ্গিবাদে মদত দান, জালিয়াতি এবং বেশুমার ব্যক্তির মানহানি। আমাকে হয়তো ‘চান্স সম্পাদক’ বিবেচনা করেই আইপিআই’র নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী এসব মামলাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। কিন্তু প্রবীণ সম্পাদক আবুল আসাদকে গাড়ি পোড়ানোর অবিশ্বাস্য অভিযোগে মধ্যরাতে বাসা থেকে এলিট বাহিনী র্যাব কর্তৃক গ্রেফতার এবং পরে রিমান্ডে পাঠানোর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর বেমালুম ভুলে যাওয়া বিস্ময়কর। অন্তত আবুল আসাদকে পেশাদার সম্পাদক মেনে না নেয়ার কোনো সুযোগ সম্ভবত মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার নেই। বয়সে আবুল আসাদের চেয়েও প্রবীণ, মনের দিক দিয়ে অবশ্য চিরসবুজ সাংবাদিক, সম্পাদক শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মানহানি মামলার বাদীর নাম আলহাজ্ব লায়ন মাওলানা মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক। ভদ্রলোক আওয়ামী লীগেরই অঙ্গসংগঠন আওয়ামী ওলামা লীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি।

শীর্ষ নিউজ ডট কমের সম্পাদক একরামুল হকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করা হয়েছে তার পত্রিকায় একজন মন্ত্রীর দুর্নীতির খবর প্রকাশের পর। মামলা দায়েরের আগে শীর্ষ কাগজের সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছিল। চাঁদাবাজি মামলার ছুতো ধরেই তাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের মুখে সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যম বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। সুতরাং, সম্পাদকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত প্রতিটি মানহানি কিংবা চাঁদাবাজি মামলার পেছনের কলকাঠি যে সরকারই নেড়েছে, এ নিয়ে জনমনে অন্তত কোনো সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী অব্যাহতভাবে অসত্য দাবি করে যেতে পারেন, তবে দেশে-বিদেশে তার এসব কথা কেবল কৌতুকেরই সৃষ্টি করবে। তবে, এটা মানতে হবে যে রিমান্ডে নিয়ে পিটুনি দিলেও সরকার এখনো পর্যন্ত রাজধানীর কোনো পত্রিকা সম্পাদককে হত্যার মতো চরম পন্থা গ্রহণ করেনি। আমার ক্ষেত্রে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একদল আততায়ী পাঠিয়েও অজানা কারণে নীতিনির্ধারকরা শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন আমার ভাগ্য সহায় হলেও সাগর এবং রুনি খুনিদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। এই তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিক দম্পতি তাদেরই শয়নকক্ষে ছুরিকাঘাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলে এবং শাসকশ্রেণীর মধ্যে সভ্যতার লেশমাত্র থাকলে এই কলঙ্কজনক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা সরকার না হলেও অন্তত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এতদিনে পদত্যাগ করতেন। পাঠক বলতে পারেন বাংলাদেশের মন্ত্রীদের কাছ থেকে এতটা বিবেকবোধ আশা করা একপ্রকার ইউটোপিয়া। উল্টো এ দেশে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও বিচার দাবি করার অপরাধে প্রধানমন্ত্রী এবং আদালতের কাছ থেকে গণমাধ্যমের কর্মীদের তিরস্কার শুনতে হচ্ছে। সাগর-রুনি হত্যার রহস্য উন্মোচন প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের প্রতিটি মহল প্রথমাবধি রহস্যময় আচরণ করে চলেছে। এই বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের রথী-মহারথীরা গত প্রায় চার সপ্তাহে কে কী বলেছেন, তার একটা তালিকা জনস্বার্থেই প্রস্তুত করেছি, যাতে ভবিষ্যতে বিপদ বুঝে এরা আগের দেয়া বক্তব্য বেমালুম অস্বীকার করতে না পারেন।

* প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
সরকারের পক্ষে কারও বেডরুমে গিয়ে পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। সাগর-রুনি তাদের বেডরুমে মারা গেছে। আমরা কি মানুষের বেডরুমে বেডরুমে পুলিশ বসাতে পারব?
* স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন
১. ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাগর ও রুনির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা হবে।
২. মিডিয়ার চাপেই ৪৮ ঘণ্টার কথা বলেছি, এটি কৌশলও ছিল।
৩. আপনারা অপেক্ষা করুন, যে কোনো মুহূর্তে সুখবর শুনতে পারবেন।
৪. সাংবাদিক দম্পতি হত্যা-মামলা প্রধানমন্ত্রী নিজেই মনিটর করছেন।
৫. তদন্ত এগিয়ে গেছে, তদন্ত কর্মকর্তারা অতি দ্রুত একটি ভালো ফল দেবেন।
৬. সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সুরাহা হবেই।
* সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকারীদের গ্রেফতারের জন্য প্রশাসনকে চাপ দিলে তারা ঘাবড়ে যেতে পারে।
* স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু
আইন-শৃঙ্খলা অবনতিসহ ঢাকায় সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত রয়েছে।
* আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার
তদন্ত শেষ করতে না পারলেও প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। খুব শিগগির আপনাদের এ ব্যাপারে ইতিবাচক অগ্রগতির কথা জানাতে পারব।
* ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ
তদন্তের কাজ ডেডলাইন দিয়ে হয় না।
* মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করলে তদন্ত ‘বিপথে’ যেতে পারে, তাড়াহুড়া করলে প্রকৃত অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে জজ মিয়া নাটকের পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
* ডিসি ডিবি মনিরুল ইসলাম
হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
* প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ
সমাজে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, বিঘ্ন করতে চায় সামাজিক জীবন তাদের দ্বারাই এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব।
* প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) মাহবুবুল আলম শাকিল
আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে মেহেরুন রুনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে বিরোধী দলের সংবাদ কাভার করতেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী তাকে খুব স্নেহ করতেন।

সাগর-রুনির ভয়ঙ্কর হত্যার ঘটনাটিকে প্রশাসন প্রথমেই পরকীয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করার কৌশল গ্রহণ করে। জনমনে রুনি সম্পর্কে বিরূপ ধারণা দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারপন্থী পত্রিকায় সোত্সাহে তার চরিত্র হনন শুরু হয়। নিহত হওয়ার পূর্ব সপ্তাহে সে তার কোন ছেলেবন্ধুকে কতগুলো এসএমএস পাঠিয়েছে, মোবাইলে কতক্ষণ কথা বলেছে এসব কেচ্ছা-কাহিনী প্রকাশ পেতে থাকে সেইসব পত্র-পত্রিকায়। শুনেছি কাকের মাংস নাকি কাক খায় না। সাগর-রুনির ক্ষেত্রে দেখলাম একশ্রেণীর সাংবাদিক তাদের সহকর্মীদের মাংসভক্ষণ করতে যথেষ্ট আনন্দই পায়! রুচি বহির্ভূত এসব আদি রসাত্মক কাহিনী বিশেষ মহল থেকে আমাদের সাংবাদিককে গেলানোর চেষ্টা করা হলেও স্বাধীনতার কথা বলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আমার দেশ-কে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয়নি। আমরা মহান সাংবাদিকতা পেশার সত্যনিষ্ঠতার প্রতি অবিচল থেকে প্রশাসনের দলবাজ কর্মকর্তাদের তদন্ত ভিন্নপথে ঘোরানোর অপচেষ্টা সম্পর্কে পাঠককে আগাম সতর্ক করেছি। রুনি ও সাগরের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দেয়ার পরিবর্তে হত্যার রহস্য উদঘাটনকেই আমার দেশ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছে। হত্যা রহস্য উদঘাটনের দাবিতে সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সর্বতোভাবে সমর্থন ও সহায়তা প্রদান করে গেছি। বিভিন্ন ব্লগে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে অপ্রমাণিত বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রকাশিত হলেও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নীতিতে অবিচল থেকে আমরা সেগুলোকেও সযতনে পরিহার করেছি। ব্লগে প্রচারিত ষড়যন্ত্রের গল্পগুলোর সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ দেয়া থাকলে নির্দ্বিধায় আমার দেশ সেগুলো প্রকাশ করত। ভবিষ্যতে কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিক তথ্য-প্রমাণসহ সরকারের ওপর মহলের সেইসব ব্যক্তিদের এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ দিতে পারলে অবশ্যই সেই কাহিনী প্রকাশ করা হবে।

এর মধ্যে সংবাদপত্র মালিকদের মধ্যকার এক ক্ষুদ্র সুশীল(?) গোষ্ঠীর এলিট সংগঠন নোয়াব এক বিবৃতি দিয়ে আমাদের হতবাক করেছে। সেই বিবৃতিতে তারা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো অনুমাননির্ভর খবর না ছাপতে এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে গণমাধ্যমের কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আজব কাণ্ড! পত্রিকার মালিকগোষ্ঠী কাদের উদ্দেশ করে বিবৃতি দিচ্ছেন? তারা স্ব স্ব পত্রিকায় এ বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করলেই এই সমস্যার উদ্ভব হতো না। তাছাড়া এই বিবৃতির মাধ্যমে মালিকরা স্বীকার করে নিলেন যে, তাদের পত্রিকায় দায়িত্বহীন আচরণ করা হয় এবং সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড ব্যতীত অন্যান্য সংবাদ পরিবেশনের বেলায় দায়িত্বশীলতার কোনো প্রয়োজন নেই। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো অনুমাননির্ভর সংবাদ ছাপা থেকে বিরত থাকার আহ্বান সংবলিত বিবৃতি দেয়া সত্ত্বেও গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা সরবরাহকৃত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অপ্রমাণিত সংবাদ নোয়াব-এর অন্তর্ভুক্ত পত্রিকাতেই নিয়মিত ছাপা হয়েছে এবং হচ্ছে। কথায় ও কাজে বিপরীতধর্মী আচরণ কেবল রাজনীতিকদের মধ্যে নয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে সর্বশেষ নাটকীয়তা আনয়নে মহামহিম আদালত বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। আদালতপাড়ায় সবিশেষ পরিচিত আওয়ামীপন্থী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোরশেদ বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এক জনসভায় প্রদত্ত একটি বক্তব্য নিয়ে ভর্ত্সনার (Censure) উদ্দেশ্যে হাজির হয়েছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের দ্বৈত বেঞ্চে। তার লক্ষ্য শতভাগ অর্জিত হয়েছে। হাইকোর্টের এই মাননীয় বিচারপতি বেগম খালেদা জিয়ার মন্তব্যকে এতই গর্হিত বিবেচনা করেছেন যে, তার সমালোচনা জানানোর উপযুক্ত ভাষা পর্যন্ত খুঁজে পাননি। হত্যারহস্য উন্মোচনে সরকারের যাবতীয় পদক্ষেপেও একই আদালত সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, নাগরিকের বেডরুম পাহারা দেয়া বিষয়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরম বিতর্কিত বক্তব্যকেও সঠিক বিবেচনা করেছেন বহুল আলোচিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। বেগম খালেদা জিয়ার অপরাধ হলো, তিনি লালমনিরহাটের জনসভায় বলেছেন যে সাগর-রুনির কাছে সরকারের দুর্নীতির তথ্য থাকার কারণেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। একজন রাজনীতিবিদ তার বক্তব্যে জনমতের প্রতিফলন ঘটাবেন, এটাই প্রত্যাশিত। বিএনপি চেয়ারপার্সনও তার বক্তৃতায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে যা বিশ্বাস করে, সেটাই নিজস্ব ভাষায় বিবৃত করেছেন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর দ্বৈত বেঞ্চের দৃষ্টিতে অবশ্য সেই বক্তব্য অতীব গর্হিত বিবেচিত হয়েছে।

আদালত থেকে আরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে গণমাধ্যমে জজ মিয়া নাটক জাতীয় বাক্যাবলী আর লেখা যাবে না এবং তথ্যসচিব গণমাধ্যমের ওপর বিশেষ বেঞ্চ কর্তৃক আরোপিত এই সেন্সরশিপ দেখভাল করবেন। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে দীর্ঘদিন পর ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক নেতারা স্বাভাবিকভাবেই আদালতের নির্দেশে অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বিষয়টিকে তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর আঘাতরূপেই বিবেচনা করছেন। সাংবাদিক মহলে কট্টর আওয়ামীপন্থী নেতারূপে পরিচিত ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের বক্তব্য এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেছেন, ‘পৃথিবীর কোথাও গণমাধ্যমের কাজে আদালতের এরকম হস্তক্ষেপের নজির নেই। আদালত কেন, কারও নির্দেশনা মেনে গণমাধ্যম দায়িত্ব পালন করবে না। হাইকোর্টের আদেশ অগ্রহণযোগ্য।’ আওয়ামীপন্থী বিএফইউজের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী মার্চের ১ তারিখে সাংবাদিকদের দিনব্যাপী গণঅনশনে সভাপতির বক্তব্যে বলেছেন, ‘আদালতের নির্দেশনা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। গণমাধ্যমের ওপর বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ সাংবাদিক সমাজ সহ্য করবে না। দু’একজন অবিবেচক বিচারপতির কারণে আদালত ও গণমাধ্যম যেন মুখোমুখি চলে না আসে, সেজন্য পদক্ষেপ নিতে প্রধান বিচারপতির কাছে আহ্বান জানাই।’ মনে হচ্ছে আসলেই বাংলাদেশে অনভিপ্রেতভাবে আদালত এবং গণমাধ্যম ক্রমেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সাগর-রুনির হত্যার তদন্তের সংবাদ পরিবেশনা নিয়ে হাইকোর্টের রুল প্রসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন জনমনে উত্থাপিত হয়েছে। আমরা এতদিন জানতাম বিচারাধীন কোনো বিষয়ে লেখালেখি করা বাঞ্ছনীয় নয়। এখন থেকে কি তদন্তাধীন বিষয় নিয়েও সংবাদপত্রে লেখা বা গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো? আইনের দৃষ্টিতে আদালতে বিচারাধীন এবং পুলিশের তদন্তাধীন বিষয় কি এক? তাছাড়া যে দেশের তথ্য আইনে জনগণের তথ্য জানার অধিকারকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, সে দেশেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সেন্সরশিপ আরোপের যে কোনো অপচেষ্টাই নিন্দনীয়। অতি উত্সাহী বাদী অ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোরশেদ একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে আদালতে টেনে নিয়ে অযথাই আদালতকে বিতর্কিত করলেন। এই আইনজীবীর মতো ব্যক্তিরা যে কখনোই আদালতের বন্ধু নন, সে বিষয়টি মাননীয় বিচারপতিরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই বিচার ব্যবস্থার জন্য মঙ্গল হবে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এতসব ডামাডোলে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে নৃশংস ও আলোচিত হত্যাকাণ্ডটি ধামাচাপা পড়ার আশঙ্কাই জনমনে দৃঢ়তর হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আজ ২৬ দিন পার হয়ে গেলেও পুলিশ হত্যাকাণ্ডের কোনো কূল-কিনারা করতে সক্ষম হয়নি। আদালত প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট হতে পারেন, কিন্তু জনগণ যে একেবারেই সন্তুষ্ট হতে পারছে না এটাই বাস্তবতা। মানুষের মন আদালতের নির্দেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যে যায় না এ বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা স্মরণে রাখলে ভালো করবেন। তরুণ সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনিকে তাদেরই শয়ন কক্ষে ঢুকে হত্যাকারীরা অত্যন্ত নির্মমভাবে যখন হত্যা করছিল, তখন পাশের ঘরে নিহতদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ ঘুমিয়ে ছিল। সেই অবোধ, ঘুমন্ত শিশু জানতেও পারেনি গভীর নিশীথে তার কত বড় সর্বনাশ ঘটে গেছে। এই মানসিক আঘাত থেকে মেঘ কোনোদিন মুক্তি পাবে কিনা জানি না। ফ্যাসিবাদী মহাজোট সরকারের অধীনস্থ রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল অংশ সম্মিলিতভাবে মেঘের নিহত পিতা-মাতাকে চরিত্রহননসহ অন্যান্য পন্থায় বড় নির্মমভাবে বার বার খুন করছে। মহান আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি যেন এই দুর্বিনীত শাসকশ্রেণীর ওপর তাঁর অভিসম্পাত বর্ষিত হয়।

 

Sunday, March 4, 2012

মনে হয় উপদেষ্টারা প্রধানমন্ত্রীর নন, ভারতের: মেনন

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, ট্রানজিট, তিস্তা, আন্তঃনদী সংযোগ বিষয়ে ভারতের সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে উপদেষ্টারা যে ধরনের কথা বলেন তা দেখে মনে হয় তারা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নয়, ভারত সরকারের উপদেষ্টা। উপদেষ্টাদের কাজের জবাবদিহিতা কেন নয়? তারা জনগণের অর্থ ভোগ করলেও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ নয়।”

রোববার জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর ধন্যবাদ প্রস্তাব জ্ঞাপনকালে তিনি এ সব মন্তব্য করেন।

পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে দীপু মনিকে সতর্ক করে তিনি বলেন, ‘‘ভারতের সঙ্গে আমাদের পররাষ্ট্রনীতি ‘নতজানু’ নয় বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন। এ কথা আমিও বিশ্বাস করি। কিন্তু পররাষ্ট্রনীতি বালখিল্যতা নয়।’’

মেনন বলেন, ‘‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর চুক্তির মধ্য দিয়ে নতুন দিগন্ত উম্মোচন হবে বলে আমরা মনে করেছি। কিন্তু টিপাইমুখ, তিস্তা, আন্তঃনদীর পানি সংযোগ বিষয়ে ভারতের আচরণ দেখে বোঝা যায় বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়িয়েছে। দুই দেশের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় ভারতকে চিন্তা করতে হবে এটা ‘ওয়ান ওয়ে ট্র্যাফিক নয়, ডাবল ওয়ে ট্র্যাফিক।’’

উভয় দেশের মধ্যকার ভুল বোঝাবুঝি বন্ধ করার জন্য পদক্ষেপ নিতে তিনি ভারত সরকারকে আহবান জানান।

তিনি বলেন, ‘‘মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাংবাদিক সাগর ও রুনির হত্যা নিয়ে যা হচ্ছে মানা যায়না। 

আমি বুঝিনা, বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন প্রধানমন্ত্রীর ওপর চাপাচ্ছেন।’’

তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন হুমকির মুখে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকারের পলিসি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। শেয়ারবাজার থেকে অর্থ লুটপাট জনমনে বিভ্রান্তি ও অসন্তোষ গড়ে উঠেছে। এ বিষয়ে আস্থা আনতে প্রধানমন্ত্রীকে ব্যবস্থা নিতে হবে।’’

তিনি বলেন, ‘‘পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক ফান্ড প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এটা অর্থনৈতিক বিষয় নয়, রাজনৈতিক। বিশ্বব্যাংক আমাদের দুর্নীতি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে, বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি প্রমাণ করবে কে? ৭৪ সালেও এভাবে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দেশে ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। আমাদের এগিয়ে যাওয়া বন্ধ করতেই তারা এমনটি করেছে।’’

তত্ত্ববধায়ক বা অন্তবর্তীকালীন সরকার বিষয়ে বিরোধী দল বিএনপিকে সংসদে এসে প্রস্তাব দেয়ার জন্য খালেদা জিয়ার প্রতি আহবান জানান তিনি। বিএনপি সংসদে এসে প্রস্তাব দিতে লজ্জা পেলে বাইরে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

 

Friday, March 2, 2012

একের পর এক নাটক সাজাচ্ছে পুলিশ – পরিবার

তদন্ত কর্মকর্তারা একবার বলছেন, তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে আবার বলছেন, উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই। একবার বলছেন, মোটিভ আর খুনি শনাক্ত। পরমুহূর্তেই বলছেন, এখনো তাঁরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত নন। কখনো বলছেন, হত্যাকাণ্ডের মোটিভ ব্যক্তিগত বা পারিবারিক, কখনো বা বলছেন, ডাকাতি বা চুরির ঘটনাও হতে পারে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একটি অংশ এ ধরনের অসংগতিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে এক 'রহস্য জাল' তৈরি করেছেন। ফলে নিহত দুজনের পরিবারসহ অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পুলিশ নানান নাটক সাজিয়ে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। খুনিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় পরিবারের সদস্যরাও মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন।

নিহত সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই ঘটনা ডাকাতি হতেই পারে না। মিথ্যাচার শুরু হয়েছে। তোমরা (সাংবাদিক) সজাগ থাকো। আগে ডাকাতির কোনো আলামত ছিল না এখন এলো কোথা থেকে? ডাকাতিই যদি ঘটে তবে ডাকাতরা কিভাবে এলো? গেলই বা কিভাবে? পুলিশ বলছে, আলামত নষ্ট হয়ে গেছে। তাহলে ওই বাসায় কারা গিয়ে আলামত নষ্ট করল? পুলিশ সেটা বের করতে পারছে না কেন? ভিসেরা টেস্ট কেন করা হয়নি? এত গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্তের কথা বলা হচ্ছে, অথচ তদন্তে আলামতই রাখা হয়নি। ঘটনার পর বলা হয়েছে বাসা থেকে কিছু খোয়া যায়নি অথচ এখন পুলিশ বলছে স্বর্ণ খোয়া গেছে। কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কিছু ঘোলাটে! এত দিন হয়ে গেল কোনো কিছু বের করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো নানান নাটক! আমরা কোথায় যাব? প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যায়বিচার চাই।'


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন সাবেক আইজি কালের কণ্ঠকে বলেন, এ রকম একটা ঘটনার পর পুলিশ সাংবাদিকদের নিয়ে বৈঠক করে তাঁদের সহযোগিতা চাইতে পারত। তদন্তে যাতে করে কোনো বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রেখে নিয়মিত ব্রিফিং দিয়ে একটা ভারসাম্য রাখতে পারত। তারা সেটা না করে গালগল্প ছড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। একেকজন একেক কথা বলছেন। এতে করে প্রকৃত ঘটনাটি আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। সৃৃষ্ট হয়েছে একটা ধূম্রজালের। কালের কণ্ঠের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমার কাছেও মনে হচ্ছে পুলিশ তামাশা করছে।'

সাগরের স্বজনরা জানান, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল সাগরের নবাবপুর রোডের বাসায় একবার গিয়েছিল। এরপর সাগরের স্বজনদের সঙ্গে তদন্তকারীরা আর যোগাযোগ করেনি। সাগরের পরিবার জানায়, বাসা কাছাকাছি হওয়ায় রুনির পরিবারের সঙ্গেই সাগর-রুনির যোগাযোগ বেশি ছিল। সাগর-রুনির দাম্পত্য সমস্যাসহ কোনো প্রকার সমস্যার কথাই জানা নেই তাঁদের। অথচ সংবাদমাধ্যমে এগুলোও আজ প্রচার পাচ্ছে।


একইভাবে নিহত রুনির ভাই এবং মামলার বাদী নওশের আলম রোমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁদের হতাশা দিনদিন বাড়ছে। তাঁরা বিস্মিত যে আজ পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করা দূরে থাক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ সম্পর্কেও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না। পুলিশ তাঁদের কিছু জানাচ্ছেও না। তাঁরা যেটুকু জানছেন সেটা প্রচারমাধ্যম থেকেই।


গতকাল যখন রোমানের সঙ্গে কথা হয় তখন তিনি নিহত দম্পতির ছেলে শিশু মেঘকে নিয়ে বসুন্ধরা সিটিতে ঘুরতে ও খেলনা কিনতে গিয়েছিলেন। টেলিফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় রোমান বলেন, মেঘও তার মা-বাবাকে খুব 'মিস' করছে। তার অনেক কথারই উত্তর দিতে পারেন না তাঁরা।


এক প্রশ্নের জবাবে রোমান বলেন, এটা কখনোই চুরি বা ডাকাতিজনিত ঘটনা হতে পারে না। তাঁদের আশঙ্কা, কোনো মহল প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। এ ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি না করে তিনি প্রকৃত রহস্য দ্রুত উদ্ঘাটনের জন্য পুলিশের প্রতি আন্তরিক আহ্বান জানিয়ে বলেন, হতাশার কারণে তাঁর মাসহ পরিবারের প্রতিটি সদস্যই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন।


নিহত সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা চলছে বলে জোরালো আশঙ্কা প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন,' আমরা শুধু আসল ঘটনা জানতে চাই। খুনি কে, দেখতে চাই।' সালেহা মনির কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরো বলেন, 'অনেক পত্রিকা যা খুশি তাই লিখছে। কিন্তু তোমরা (কালের কণ্ঠ) ভালোভাবে লিখছো। আজেবাজে কথা না লিখে প্রকৃত ঘটনা তোমরা বের করো। এখন তোমরা আমার সাগর। তোমাদের ভাইয়ের খুনিকে বের করো...।'


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের সাবেক ওই আইজি কালের কণ্ঠকে আরো বলেন, 'আমি নিজেই মনে করি না এটা ডাকাতি বা চুরিজনিত খুন। চোর বা ডাকাত কাউকে হাত-পা বেঁধে খুন করবে না। অপরাধবিজ্ঞান বা অপরাধের চলমান ধরন মতে, এটা করার কথা নয়। এটা কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডও হতে পারে না। যতটুকু জানি, সাগর আর রুনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ফলে কোনো রাজনৈতিক চাপও পুলিশের ওপর থাকার কথা নয়। কিন্তু সেই রকম কথাও পত্রিকান্তরে প্রকাশ পাচ্ছে। আমি মনে করি না, কোনো দলের শীর্ষপর্যায় থেকে আসছে নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ধরনের ঝুঁকি কেউ নেবে। এ অভিযোগ ঠিক নয় ধরে নিয়ে অন্তত এটুকু বিশ্বাস আর আস্থা রাখতে চাই। আর তাই আমি মনে করি, যদি সময়ও লাগে তবু একটি পরিপূর্ণ আর বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হওয়া উচিত। সেটা না হলে পুলিশ তাদের আস্থার অনেকটা জায়গা হারাবে।'

এ ব্যাপারে পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, কে কোনটা বিশ্বাস করবে কি করবে না, সেটা তদন্তের বিষয় নয়। ওটা মাথায় রেখে তদন্ত করা যায় না। তদন্ত হচ্ছে প্রকৃত ঘটনা বা সত্যকে বের করে আনা। তদন্তে যদি প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হয়, আর সেই সত্যটাও যদি বিশ্বাসযোগ্য না হয়, তখন কারই বা কি করার থাকে। সত্যকে মেনে নিতেই হবে।

আইজিপি আরো বলেন, এ ধরনের ঘটনা খুব একটা বেশি নয়, যেটা দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, সচিব, আইজিপি সার্বক্ষণিক তদারকি করেন। এ মামলার ক্ষেত্রে সেটাও করা হচ্ছে। ডিবির পাশাপাশি অন্য সংস্থাগুলোও এ ঘটনা নিয়ে তাদের মতো করে কাজ করছে। সবার একটাই উদ্দেশ্য, প্রকৃত সত্যকে খুঁজে বের করা। ফলে কারো মনে কোনো ধরনের সন্দেহ রাখার প্রয়োজন নেই। একটা আস্থার জায়গা তো মানুষের থাকতে হবে। তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই এই জোড়া খুনের রহস্য উন্মোচন হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, পুলিশের ওপর যে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ আগে হয়নি, তা নয়। তবে এই সরকারের আমলে পুলিশ যতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, এর আগে কখনো সেটা পারেনি। এ ধরনের ঘটনায় কারো কোনো চাপকে গ্রাহ্য করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে হ্যাঁ, চাপ আছে। সেটা হচ্ছে প্রকৃত খুনিদের খুঁজে বের করা। এটা শুধু ঊর্ধ্বতন মহলের নয়, এটা বিবেক আর দায়িত্বেরও চাপ। আর সেই চাপেই পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। আসলে আসামি গ্রেপ্তার করতে দেরি হওয়ার কারণেই এসব অভিযোগ উঠছে। ভিত্তিহীন হলেও এই মুহূর্তে এটা অস্বাভাবিক নয়। আদালতের নির্দেশ থাকায় এখন তাঁরা ইচ্ছা থাকলেও আর কোনো প্রেস ব্রিফিং করতে পারছেন না। কারণ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো তথ্যকেই আক্ষরিক অর্থে নিশ্চিত বলা চলে না। ফলে প্রচারমাধ্যমের কর্মীরাও তাঁদের ভুল বুঝছেন। তবে এটা সত্য, এই জোড়া খুনের ঘটনা জটিল আর স্পর্শকাতর হওয়ার কারণে প্রত্যাশার চেয়ে তাঁদের অনেক বেশি সময় লাগছে। আর এতেই সাধারণের মনে অনেক সন্দেহ দানা বাঁধছে। রহস্য বের হলেই সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে বলে তিনি জানান।

BY :  Parvez Khan. 

মিডিয়ার স্বাধীনতা - শেখ হাসিনা স্টাইল

বাংলাদেশের মিডিয়া এখন পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করছে। সরকার এর ওপর কোনো আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সেন্সরশিপ আরোপ করেনি। গত তিন বছরে সরকার কোনো সাংবাদিক বা সম্পাদকের বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করেনি।



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দাবি করেছেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সফররত ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের (আইপিআই) নির্বাহী পরিচালক এলিসন বেথেল ম্যাকেঞ্জি তার দফতরে সাক্ষাত্ করতে গেলে তিনি বাংলাদেশের মিডিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে এ বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রী আইপিআই নির্বাহী পরিচালককে আরও জানান, তার সরকার সাংবাদিকদের হয়রানিতে বিশ্বাস করে না। গত বিএনপি সরকারের আমলে স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা রাখার কারণে একটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বলেও তিনি মন্তব্য করেন।



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন এক সময়ে এ বক্তব্যটি দিয়েছেন, যখন গোটা সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে আন্দোলনে রয়েছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে গতকালও সাংবাদিকরা গণঅনশন কর্মসূচি পালন করেছেন। হাইকোর্টের একটি মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মিডিয়ায় সেন্সরশিপ আরোপ হতে পারে এ আশঙ্কায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে যুক্ত বিবৃতিও দিয়েছেন সাংবাদিকরা। গণঅনশন সমাবেশ থেকে তারা বলেছেন, কারও নির্দেশনায় গণমাধ্যম চলবে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।



শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্যটি এমন সময়ে দিয়েছেন, যখন বাংলাদেশের মিডিয়া পরিস্থিতি নিয়ে শুধু দেশের ভেতরেই উদ্বেগ জানানো হচ্ছে না, বিদেশীরাও এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) সাংবাদিক দম্পতি হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর নিকৃষ্ট দেশগুলোর অন্যতম। একই ধরনের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, ইন্টারন্যাশনাল প্রেস অ্যাসোসিয়েশন, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও মানবাধিকার সংগঠন।



সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেক। তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, এনজিও, সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে মতবিনিময় করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এরপর জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন। রবার্ট ও ব্লেক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। তিনি স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। 

সফররত আইপিআই নির্বাহী পরিচালক এলিসন বেথেল ম্যাকেঞ্জিও জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার কোনো বিচার না হওয়ায় আইপিআই উদ্বিগ্ন।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য কতটুকু যৌক্তিক তা বিদেশী সংস্থা ও ব্যক্তিদের উপরের মূল্যায়ন থেকেই বোঝা যায়। তাছাড়া গত তিন বছরে যা ঘটেছে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করলেই পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। আসলে অনুসন্ধানেরও প্রয়োজন হয় না। গণমাধ্যম দলনের একের পর এক যে ঘটনা ঘটেছে, তা দেশের প্রতিটি মানুষেরই জানা। একটি শিশুকে প্রশ্ন করলেও অনায়াসে সে বলে দিতে পারবে সাংবাদিকরা কখন কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার মুখে স্বাধীনতার কথা বলে, বাস্তবে তাদের হাতে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত ও নির্যাতিত হচ্ছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের গ্রেফতার, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, বিভিন্ন শ্রেণীর মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া, কথায় কথায় মামলা ও লাঞ্ছিত করা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।



গত দুই বছরে জাতীয় পর্যায়ের তিনজন সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু গ্রেফতারই নয়, রিমান্ডে নিয়ে বর্বর কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের তিন বছরে ১৪ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। একটি হত্যাকাণ্ডেরও আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। 

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের রিপোর্টেই দেখা যায়, ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের তিন বছরে সাংবাদিকদের ওপর ৫২৯টি হামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১১ সালে সবচেয়ে বেশি ২০৬টি হামলা হয়েছে। এসব হামলায় এক হাজারেরও বেশি সাংবাদিক আহত হয়েছেন। কেউ কেউ পঙ্গুত্ববরণে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে নিজ এলাকায় থাকতে পর্যন্ত পারছেন না, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। চলতি বছরে আরটিভির রিপোর্টার অপর্ণা সেনের ওপর আওয়ামী লীগ এমপি কামাল মজুমদারের হামলা ও তাকে নাজেহাল করা আলোচিত একটি ঘটনা। তেমনি ঝিনাইদহ-৩ আসনের আওয়ামী লীগ এমপি শফিকুল আজম খানসহ দলের ক্যাডাররা গত ১৯ জানুয়ারি পিটিয়েছে স্থানীয় সাংবাদিক শহিদুল ইসলামকে। পুলিশ আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সরকারদলীয় একজন পৌর মেয়রের আক্রমণে গুরুতর আহত হন আমার দেশ-এর ঝিনাইদহ প্রতিনিধি আরিফুল আবেদীন টিটো। বর্তমানে তিনি ঢাকায় পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন। এ ধরনের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে।



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কোনো সাংবাদিক বা সম্পাদকের ওপর একটি মামলাও দেয়া হয়নি। কথাটা তিনি কীভাবে বললেন? এটা কি নির্জলা মিথ্যাচার নয়? দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৫৩টি মামলা দেয়া হয়েছে। এসব মামলা শুধু সরকারি দলের নেতা-কর্মীরাই দেননি, সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা, বিটিআরসির মতো সংস্থা এবং পুলিশের পক্ষ থেকে দায়ের করা হয়েছে। এক সরকারের আমলে একজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে এতগুলো মামলার ঘটনা বাংলাদেশ সৃষ্টির ৪০ বছরের ইতিহাসে আর কোনো নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, সাজানো মামলায় তাকে বর্বরোচিতভাবে দৈনিক আমার দেশ কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়ে রিমান্ডে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়েছে। আদালতে মাহমুদুর রহমান নিজেই তার বর্ণনা দিয়েছেন, সেগুলো নথিভুক্ত করা আছে। তাছাড়া তিনি তার 'জেল থেকে জেলে' বইয়েও সেগুলো সবিস্তারে লিখেছেন। গ্রেফতারের আগে তার প্রাণনাশের চেষ্টায় কয়েকবার হামলা চালানো হয়েছে। শুধু মাহমুদুর রহমানই নয়, ঊনসত্তর বছর বয়সী প্রবীণ খ্যাতিমান সম্পাদক আবুল আসাদকে একটি রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়েছে। তাকে ৬ দিনের রিমান্ডের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। অবশেষে সাংবাদিকদের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত রিমান্ডে আর যেতে হয়নি। তেমনি দুর্নীতির রিপোর্ট লেখার কারণে শীর্ষ নিউজ ডট কমের সম্পাদক একরামুল হককেও গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে।



মিডিয়া বন্ধ করার বড় নজির তো দৈনিক আমার দেশই। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয় ও জ্বালানি উপদেষ্টার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগের রিপোর্ট করার 'অপরাধে'(!) দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। শত শত পুলিশ পত্রিকা অফিসে ঢুকে সম্পাদককে গ্রেফতার এবং সাংবাদিকদের মারধর করে পত্রিকা অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়, প্রেস সিলগালা করে দেয়া হয়। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দেয়া হয় সাজানো মামলা। এখনও সাংবাদিকদের এ মামলায় কোর্টের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরতে হয়। ৪৭ দিন বন্ধ থাকার পর অবশেষে কোর্টের রায়ে আমার দেশ প্রকাশিত হচ্ছে। বেসরকারি টিভি চ্যানেল&mdashচ্যানেল ওয়ান এ সরকারই বন্ধ করে দিয়েছে।



এখন পর্যন্ত চ্যানেলটি পুনরায় চালুর কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি। তেমনি শীর্ষ নিউজ ডট কম এবং শীর্ষ কাগজও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।



এ তো গেল মিডিয়া বন্ধের কথা। মিডিয়ার প্রতি সরকার কি আচরণ করছে, তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেসব পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল ভিন্নমত পোষণ করছে তাদের সঙ্গে সরকার বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। দৈনিক আমার দেশ, দৈনিক নয়া দিগন্ত, দৈনিক সংগ্রাম এবং দৈনিক দিনকালকে সরকারি বিজ্ঞাপন দেয়া তিন বছর ধরেই বন্ধ। দৈনিক আমার দেশ প্রচার সংখ্যার দিক দিয়ে এখন চার নম্বর অবস্থানে রয়েছে। ইন্টারনেট পাঠক সংখ্যার দিক দিয়ে আমার দেশ-এর অবস্থান দ্বিতীয়, অর্থাত্ প্রথম আলোর পরেই। কিন্তু এই জনপ্রিয় পত্রিকাটিতে সরকারি বিজ্ঞাপন নেই। বছরে ৬০-৭০টি সরকারি ক্রোড়পত্র পত্রিকায় দেয়া হয়। কিন্তু আমার দেশ একটি ক্রোড়পত্রও পায় না। এমনকি সশস্ত্র বাহিনী দিবসের বিজ্ঞাপনটিও আমার দেশকে দেয়া হয়নি। শুধু বিজ্ঞাপনই নয়, সরকারি দাওয়াতের ক্ষেত্রেও ওই চার-পাঁচটি পত্রিকাকে অলিখিতভাবে কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কোনো ব্রিফিং হলে সেই ব্রিফিংয়ে আমার দেশসহ ওই পত্রিকাগুলোকে দাওয়াত দেয়া হয় না। সম্প্রতি ব্যর্থ সেনা ক্যু সম্পর্কে সেনা সদরে যে সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছিল, সেখানে আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম, দিনকাল এবং নিউএজকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অথচ সংবাদ সম্মেলনে আমার দেশ-এর একটি খবর সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হয়, খবরটি সঠিক হওয়া সত্ত্বেও।


সম্প্রতি পুলিশের একজন দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমরা যা বলি সেটাই নোট করতে হবে। কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। অথচ সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে করেই সত্য উদঘাটন করে থাকেন।



রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ফাঁসির আসামিদের দণ্ড মওকুফ করে দিয়েছেন। সেটা কেন মওকুফ করা হলো, জানার অধিকার এখন সাংবাদিকদের নেই।



প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারি দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা পর্যন্ত তাদের স্বার্থের টোকা লাগলেই দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যথেচ্ছ ভাষা ব্যবহার করে আক্রমণ করছেন। জনসভা, সেমিনার, মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক এমনকি সংসদ অধিবেশনেও মিডিয়ার ওপর বিষোদগার করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রীদের উদ্দেশে বলেন, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনো পত্রিকা অসত্য সংবাদ প্রকাশ করলে ওই পত্রিকার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করুন। সাবধান করার পরিবর্তে মামলা করার কথা বলায় মন্ত্রীসহ দলীয় লোকেরা মিডিয়ার প্রতি অনৈতিক আচরণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিছুদিন আগে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান একটি পত্রিকার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন খবরের অভিযোগে ১০ কোটি টাকা দাবি করে মামলা করেছেন। তিনি বলেছেন, ক্ষতিপূরণের এই টাকা পেলে তিনি নাকি সাংবাদিকদের শিক্ষিত করার জন্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট করবেন।


গত ৯ ডিসেম্বর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বেশকিছু মিডিয়া মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী গণভবনে কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশে বক্তব্যে বলেন, মিডিয়া যা ইচ্ছা তা লিখছে।

কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে বলেন, চাইলেই আমরা ওই সম্পাদককে গ্রেফতার করতে পারি। একইভাবে সংসদেও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে সরকারের নীতি-নির্ধারক ও এমপিরা বক্তব্য দিয়েছেন।


একদিকে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারদলীয় নেতারা অহরহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলতে দম পাচ্ছেন না, অন্যদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিষোদগারের পাশাপাশি মিডিয়া দলন চালানো হচ্ছে। সাংবাদিক নির্যাতনের নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে। মারধর ও হত্যা করা হচ্ছে।



প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো সেন্সরশিপ নেই। কিন্তু বেসরকারি টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোর টকশো রোষানলে পড়েছে। টকশোতে যারাই সরকারের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় সমালোচনা করে বক্তব্য রাখছেন, অলিখিত আদেশ কিংবা অদৃশ্য ইঙ্গিতে দেখা যাচ্ছে তাকে আর টকশোতে ডাকা হচ্ছে না।


আইপিআই নির্বাহী পরিচালককে প্রধানমন্ত্রী জানান, বিগত বিএনপি সরকার একটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সারাদেশের মানুষ জানে, উচ্চ আদালত তথা হাইকোর্ট এবং পরবর্তীকালে আপিল বিভাগের রায়ে ইটিভি বন্ধ করা হয়েছিল।



আসলে আওয়ামী লীগ কখনোই মিডিয়ার স্বাধীনতাকে সহ্য করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল। সে সময় শত শত সাংবাদিক বেকার হয়ে পড়েছিলেন। ১৬ জুন এখনও সাংবাদিকরা কালো দিবস পালন করে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণকারী কালো আইনটিও ওই সময়ই করা হয়। তেমনি ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে দৈনিক বাংলা, টাইমস, বিচিত্রা ও আনন্দ বিচিত্রা বন্ধ করে দিয়ে পাঁচ শতাধিক পেশাজীবী সাংবাদিককে বেকার করে দেয়।

 সাংবাদিকদের ন্যায্য পাওনা নিয়েও তখন সরকার গড়িমসি করেছিল। প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন সাংবাদিকদের পাওনা আদায়ের জন্য টানা কয়েকদিন প্রেস ক্লাবে অনশন করেন। অনশনে তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে পড়লে সরকার সাংবাদিকদের পাওনা পরিশোধে বাধ্য হয়। তারপরও পুরো টাকা এখনও অনেকেই পাননি। দৈনিক বাংলার সাংবাদিক হিসেবে সরকারের কাছে এখনও আমার দুই লাখ টাকা পাওনা রয়েছে।



এসব উদাহরণ থেকে এটাই পরিষ্কার যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইপিআই নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গে বৈঠকে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা অসত্যই নয়, নির্জলা মিথ্যাচার।

BY  : Syed Abdal Ahmed.