Sunday, February 12, 2012

বাংলাদেশ-ভারত সাইবার যুদ্ধ!

'সাইবার যুদ্ধে' নেমেছে বাংলাদেশ ও ভারতের হ্যাকাররা। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে দুই দেশের ওয়েবসাইটগুলোতে পাল্টাপাল্টি আক্রমণ চলছে। ইতিমধ্যেই দুই দেশের কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটসহ সহস্রাধিক সাইট হ্যাক্ড হয়েছে। প্রতিপক্ষের ওয়েবসাইটের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখানে লিখে দেওয়া হচ্ছে নিজেদের স্লোগান।
ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের (বিএসএফ) হাতে নিরীহ বাংলাদেশি হত্যার প্রতিবাদে 'বাংলাদেশ ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকারস' (বিবিএইচএইচ) গ্রুপ গত বৃহস্পতিবার নতুন করে ভারতের বিরুদ্ধে সাইবার যুদ্ধ ঘোষণা করে। এরপর ভারতীয় হ্যাকার গ্রুপগুলোও বাংলাদেশি সাইবার স্পেস ধ্বংস করে দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়ে পাল্টা হামলা চালায়।
  ইতিমধ্যে ভারতীয় হ্যাকার গ্রুপের আক্রমণে পড়েছে বাংলাদেশ সরকারের ছোট-বড় অর্ধশত ওয়েবসাইট। পাশাপাশি ৩০০ থেকে ৪০০ বেসরকারি এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটও ইতিমধ্যে আক্রমণের শিকার হয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশি হ্যাকারদের কবলে রয়েছে শতাধিক ভারতীয় ওয়েবসাইট। এর মধ্যে সরকারি এবং বড় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটও রয়েছে। বৃহস্পতিবার শুরু করেছিল বাংলাদেশ। এরপর ওই দিন রাতের প্রথম আক্রমণেই বাংলাদেশ পুলিশের ওয়েবসাইট থেকে অনেক তথ্য অনলাইনে প্রকাশ করে দেয় ভারতীয় হ্যাকাররা। প্রকাশিত একটি ডকুমেন্টে দেখা যায়, পুলিশের ওয়েবসাইটের গুরুত্বপূর্ণ ইউজারনেম ও পাসওয়ার্ড রয়েছে সেখানে। গত শুক্রবার বাংলাদেশের পাঁচটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ভারতীয় হ্যাকাররা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এগুলো হলো যোগাযোগ, টেলিযোগাযোগ, যুব ও ক্রীড়া, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আক্রান্ত হয়েছে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ওয়েবসাইটও। গত শনিবার রাত ৯টার দিকে চারটি মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে গিয়ে কালো স্ক্রিনে লেখা দেখা যায়, 'হ্যাক্ড বাই লাভ দ্য রিস্ক, অমল লন্ধে, এলএনএঙ্ রুট, সাইলেন্ট কিলার।' একইভাবে হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে রাজশাহীর পুলিশ কমিশনারের ওয়েবসাইট, ফায়ার সার্ভিসের ওয়েবসাইট, বরিশাল জেলা প্রশাসনের ওয়েবসাইট। ভারতীয় হ্যাকারদের কবলে বাংলাদেশের অর্ধশতাধিক সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক্ড হয়েছে বলে জানা গেছে।
তবে হ্যাকিং সংবাদ পোর্টাল সিকিউরিটি রে বলছে, ভারতীয় হ্যাকাররা শতাধিক ওয়েবসাইট হ্যাক করেছে, আর বাংলাদেশি হ্যাকাররা দাবি করেছে তারা পাঁচ শতাধিক ওয়েবসাইট আক্রমণে সক্ষম হয়েছে। অবশ্য দুই দেশেই হ্যাক্ড হওয়া সাইটগুলোর বেশির ভাগ সংশ্লিষ্ট সাইট কর্তৃপক্ষ পুনরুদ্ধার করে ফেলেছে।

গত শনিবার ওয়েবসাইট হ্যাক্ড হওয়ার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিষয়টি জানতে পেরেছি, ওয়েবসাইট পুনরায় সচল করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।'

বিবিএইচএইচের ঘোষণার পর আরো কয়েকটি বাংলাদেশি হ্যাকার গ্রুপ তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে ভারতীয় ওয়েবসাইটগুলোতে আক্রমণ শুরু করে। ইতিমধ্যে 'এঙ্পায়ার সাইবার আর্মি' এবং 'বাংলাদেশ সাইবার আর্মি' গ্রুপের নাম পাওয়া গেছে। ওদিকে ভারতীয় হ্যাকারদের নেতৃত্ব দিচ্ছে 'ইন্ডিশেল' নামের একটি গ্রুপ। বাংলাদেশ এবং ভারতীয় হ্যাকারদের মধ্যে কথোপকথনের একটি ডকুমেন্ট কালের কণ্ঠের হাতে এসেছে। সে ডকুমেন্ট থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

এদিকে গতকাল রবিবার দুপুরে বাংলাদেশ ব্লাকহ্যাট হ্যাকারস গ্রুপের সদস্যরা ভারতের একটি বড় মাপের সার্ভার হ্যাক করেছে, যেখানে দেড় হাজারেরও বেশি ভারতীয় ওয়েবসাইট হোস্ট করা ছিল। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আজ সোমবার রাতে জোরালোভাবে পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে ভারতীয় হ্যাকার গ্রুপগুলোও। সূত্র মতে, তাদের প্রধান টার্গেট বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সার্ভার আক্রমণ। এটি করা সম্ভব হলে সার্ভারে থাকা কয়েক হাজার বাংলাদেশি ওয়েবসাইট ভারতীয় হ্যাকারদের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। একই সঙ্গে ডটকম ডটবিডি ডোমেইনগুলোর নিয়ন্ত্রণও পেয়ে যাবে তারা। তবে ভারতীয় হ্যাকারদের সব আক্রমণ প্রতিহত করা হবে বলে জানিয়েছেন 'বাংলাদেশ সাইবার আর্মি' সঞ্চালকরা।

সাইটের নিরাপত্তা বৃদ্ধির পরামর্শ : ইন্টারনেট নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং সেন্টার ফর টেকনোলজি ডেভেলপমেন্টের প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা জাবেদ মোর্শেদ জানান, 'এখন আমাদের ইমেডিয়েট কাজ হবে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ সাইটগুলো যে ওয়েব সার্ভারে আছে তার নিরাপত্তার দিকগুলো খতিয়ে দেখা। যত দ্রুত সম্ভব ওয়েব সার্ভারের লেটেস্ট ভার্সনে আপগ্রেড করত হবে। এ ছাড়া সার্ভারের কোনো সিকিউরিটি প্যাঁচ থাকলে তা আপডেট করা, অ্যাডমিন ও সি প্যানেলের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন এবং প্রয়োজনে শক্তিশালী করাটাও বেশ জরুরি।'

তথ্যপ্রযুক্তিবিদ মোস্তফা জব্বার কালের কণ্ঠকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে যারা ওয়েবসাইটগুলো তৈরি করছেন, তাঁরা যথাযথভাবে ওয়েবসাইটের নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেই হ্যাকারদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন। ওয়েব নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, নিয়ন্ত্রণে অবহেলার কারণেই এমনটি হচ্ছে। মোস্তফা জব্বার বলেন, হ্যাকাররা রাষ্ট্রের ভয়াবহ ক্ষতি করছে, তারা যেকোনো দেশেরই হোক না কেন, তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে ধ্বংসের জন্য যেন ওরা মাঠে নেমেছে।

বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ : 'বাংলাদেশ ব্ল্যাকহ্যাট হ্যাকার' গ্রুপ ভিডিও শেয়ারিং সাইট ইউটিউবে বিএসএফ প্রধানের উদ্দেশে একটি ভিডিও বার্তাও প্রকাশ করেছে। বার্তায় বলা হয়, 'হ্যালো বাংলাদেশের নাগরিকরা, আমরা বাংলাদেশ ব্ল্যাকহ্যাট হ্যাকারস। এখন সময় আমাদের চোখ খুলবার। বিএসএফ এক হাজারেরও বেশি বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে। তাদের গুলিতে আহত হয়েছে আরো ৯৮৭ বাংলাদেশি। অপহৃত হয়েছে হাজারো মানুষ। এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। তারা অবিচার করছে। সংকটময় এ মুহূর্তে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে আমাদের কিছু দায়িত্ববোধ রয়েছে, আমরা চাই ভারত সরকার নিরপরাধ বাংলাদেশিদের হত্যা করা বন্ধ করুক। নতুবা আমরা ভারতীয়দের বিরুদ্ধে সাইবার যুদ্ধ শুরু করব। এটি চলতেই থাকবে।'

এদিকে হ্যাকিং সংবাদ পোর্টাল সিকিউরিটি রে সূত্রে জানা গেছে ইন্ডিশেল হ্যাকার গ্রুপের পাল্টা পরিকল্পনার কথা। এ গ্রুপের এফএফই এসএসএঙ্টি প্রিন্স ফেসবুক স্ট্যাটাসে বলেন, 'পাকিস্তানে অপারেশনের পর আমরা এখন চিন্তা করছি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপারেশন শুরু করব। বাংলাদেশি হ্যাকার গ্রুপ বিবিএইচএইচের কিছু হ্যাকারের আচরণের কারণে আমাদের এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। ইন্ডিশেল হ্যাকার দল এখন দেখাবে হ্যাকিং কাকে বলে!'

প্রায় মাসখানেক ধরেই দুই দেশের সাইবার আর্মি গ্রুপগুলোর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। মূলত সীমান্ত হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশি হ্যাকাররা ভারতীয় ওয়েবসাইটগুলো আক্রমণ শুরু করলে ভারতীয় হ্যাকাররাও এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে ওঠে।
  গত মাসে বাংলাদেশি হ্যাকার গ্রুপ বিবিএইচএইচ প্রথম আলোচনায় আসে অর্ধশতাধিক ভারতীয় ওয়েবসাইট হ্যাক করে। এর মধ্যে ভারত সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ ওয়েবসাইটও ছিল। গত ২৫ থেকে ২৮ জানুয়ারির মধ্যে ব্ল্যাকহ্যাট হ্যাকারের সদস্যরা এগুলো হ্যাক করে। অধিকাংশ সাইটের হোমপেইজ পরিবর্তন করে সেখানে লেখা হয়েছে, 'ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) কর্তৃক বাংলাদেশি হত্যার প্রতিবাদে সাইটগুলো হ্যাক করা হলো।' কয়েকটি সাইটে বিএসএফের হত্যাকাণ্ডের শিকার কিশোরী ফেলানীর ঝুলন্ত লাশের ছবিও যুক্ত করে দেওয়া হয়।
হ্যাকিংয়ের পর ভারতের মহারাষ্ট্রের হাইওয়ে পুলিশের ওয়েবসাইটে 'অ্যাবাউট আস' পেইজে লেখা হয়, 'সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক ১৫ বছরের কিশোরী ফেলানী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এটি আমরা কখনো ভুলব না, কখনো ক্ষমা করব না এবং তাদেরকে ছেড়ে দেব না। সীমান্তে হত্যাকাণ্ড বন্ধ করো, অথবা আমরা তোমাদের সাইবার স্পেস ধ্বংস করে দেব। কোথায় তোমাদের মানবিকতা, কোথায়? এটি বিএসএফের জন্য খুব লজ্জাজনক।' এ হ্যাকিং ঘটনার পরের সপ্তাহেই বিএসএফের ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের কবলে পড়ে। বাংলাদেশি হ্যাকাররা ডিস্ট্রিবিউটেড ডেনিয়েল সার্ভিস (ডিডস) আক্রমণ করে বিএসএফের ওয়েবসাইট অফলাইন করে ফেলে। এরপর টানা ছয় ঘণ্টা ওয়েবসাইটটি ভিজিট করতে পারেননি কেউ। ভিজিটরদের ওয়েবসাইটের কনটেন্ট না দেখিয়ে সোর্সকোর্ড দেখাচ্ছিল ব্রাউজার।

এবার 'অপারেশন ইন্ডিয়া, ফেজ-২' : সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই যেন বাড়ছে লড়াইয়ের তীব্রতা। বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে হ্যাকারদের স্বাগত জানাচ্ছেন অনেকে, অংশ নিতে চাইছেন ভারতের বিরুদ্ধে এই সাইবার যুদ্ধে।
  আর এ কারণে 'অপারেশন ইন্ডিয়া, ফেজ-২' নামে নতুন সাইবার আক্রমণ পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে বাংলাদেশি হ্যাকাররা।
ভারতীয় হ্যাকার কর্তৃক বাংলাদেশি ওয়েবসাইটগুলোতে আক্রমণ শুরু হওয়ায় আতঙ্কে আছেন অনেক বাংলাদেশি ওয়েব মাস্টার। কম নিরাপত্তাবিশিষ্ট ওয়েবসাইটগুলো সহজেই ভারতীয় হ্যাকারদের আক্রমণে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বাংলাদেশি ওয়েব মাস্টারদের ওয়েবসাইটের ব্যাক-আপ রাখা এবং নিরাপত্তা বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা।

গত বৃহস্পতিবার থেকে এই সাইবারযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে যত সময় যাচ্ছে ততই বাড়ছে সাইবার আক্রমণ। বাংলাদেশি হ্যাকাররা বলছে, 'যতক্ষণ সীমান্ত হত্যাকাণ্ড না থামবে ততক্ষণ থামবে না আমাদের সাইবার যুদ্ধ।' এদিকে ভারতীয় হ্যাকার গ্রুপ ইন্ডিশেলের বরাত দিয়ে সিকিউরিটি রে জানিয়েছে, বাংলাদেশি হ্যাকারদের আক্রমণ না থামলে তারাও তাদের আক্রমণ থামাবে না।'

এদিকে দুই দেশের এ 'সাইবার ওয়্যার' বেশ গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে আন্তর্জাতিক হ্যাকার কমিউনিটিগুলো। 'ব্ল্যাকহ্যাট হ্যাকার' গ্রুপের একজন মডারেটর নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আন্তর্জাতিক হ্যাকার গ্রুপ জেডএইচসি এবং দ্য হ্যাকার আর্মি ইতিমধ্যে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। তা ছাড়া বাংলাদেশি হ্যাকাররাও বেশ দক্ষ। ভারত তাদের সীমান্ত হত্যাকাণ্ড না থামালে আমরা পুরো ভারতের সাইবার স্পেসকে হেল বানিয়ে দেব।'

বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং আলোচিত হ্যাকার গ্রুপ অ্যানোনিমাসও বাংলাদেশি হ্যাকার গ্রুপগুলোর সঙ্গে কাজ করবে বলে স্থানীয় হ্যাকাররা দাবি করছে। তবে অ্যানোনিমাস অফিসিয়ালি কোনো ভিডিও প্রকাশ করেনি বা তথ্য দেয়নি। এ ব্যাপারে বাংলাদেশি হ্যাকার গ্রুপের একজন মডারেটর জানান, 'অ্যানোনিমাসের শীর্ষস্থানীয়দের থেকে ইতিমধ্যে আমরা সম্মতি পেয়েছি।'
  Source :