Wednesday, March 7, 2012

সাগর-রুনিকে দ্বিতীয়বার খুন

ফ্যাসিবাদী সরকারের চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার গত তিন বছরে গণমাধ্যমকে তার অন্যতম প্রতিপক্ষরূপে বিবেচনা করেছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার হেন অপচেষ্টা নেই, যা ক্ষমতাসীন মহল এই সময়ের মধ্যে গ্রহণ করেনি। বিজ্ঞাপন বন্ধ, টেলিভিশনে কালো তালিকা প্রণয়ন, সরকারি দলের চেলা-চামুণ্ডাদের হুমকি—এসব পন্থা মাত্রাভেদে সব সরকারই বিভিন্ন সময়ে স্বাধীন বাংলাদেশে ব্যবহার করেছে। তবে দিনবদলের সরকার যে ভিন্নমত দমনের জন্য অন্য প্রকারের ভয়ঙ্কর চণ্ডনীতি ব্যবহার করবে, সেটা বোঝা গিয়েছিল ২০০৯ সালের ডিসেম্বরে দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতির সংবাদ প্রকাশের প্রতিক্রিয়া থেকে। পেশাদার কিংবা ‘চান্স’ নির্বিশেষে পত্রিকার সম্পাদকদের ধরে ধরে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের বর্বর নজির সৃষ্টিতে বর্তমান ক্ষমতাসীন মহল সভ্যতা-ভব্যতা, রীতি-নীতি, আইন-কানুনের কোনোরকম তোয়াক্কা করেনি।

সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ পেশাদার সম্পাদক এবং নির্ভেজাল ভালোমানুষ দৈনিক সংগ্রামের আবুল আসাদের দুর্বল শরীরের দিকে তাকিয়েও পুলিশের অন্যায় ও আইন বহির্ভূত রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করতে ‘স্বাধীন’ আদালতের মধ্যে বিন্দুমাত্র দ্বিধা লক্ষ্য করা যায়নি! প্রথম আলোর প্রভাবশালী সম্পাদক মতিউর রহমানকে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব.) তারেক সিদ্দিকী রীতিমত সংবাদ সম্মেলন ডেকে যখন ইচ্ছা গ্রেফতারের হুমকি দিয়েছেন। মার্কিন দূতাবাসের সরাসরি হস্তক্ষেপে সেই বিশিষ্ট সুশীল(?) সম্পাদক আমার ও আসাদ ভাই-এর ভাগ্য বরণ করা থেকে সে যাত্রা বেঁচে গিয়েছিলেন। শীর্ষ কাগজের সম্পাদক একরামুল হককে রিমান্ডে নিয়ে তার পত্রিকা বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। আমার বিষয় নিয়ে দেশে-বিদেশে এত বেশি আলোচনা হয়েছে যে, সেগুলোর পুনরুল্লেখ নিষ্প্রয়োজন। মোট কথা, পত্রিকা সম্পাদক নামক ইনস্টিটিউশনটিকে অমর্যাদা করা বর্তমান সরকারের আমলে ডাল-ভাতে পরিণত হয়েছে। অথচ ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিউটের (আইপিআই) নির্বাহী পরিচালক আলিসন বেথেল ম্যাকেঞ্জি তার বাংলাদেশ সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে আমাদের প্রধানমন্ত্রী কী অম্লান বদনেই না দাবি করলেন যে, তার আমলে নাকি সরকার কোনো সম্পাদকের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের করেনি! সেদিন তিনি বলেছেন, যে মামলাগুলো হয়েছে বা হচ্ছে তার সবই সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের দায়েরকৃত মানহানি মামলা। প্রধানমন্ত্রীর আসনে থেকে অসত্য ভাষণ সেই আসনের জন্য যে বিশ্রী রকমের অমর্যাদাকর একথার সঙ্গে আশা করি, সব পাঠক একমত হবেন।

আমার বিরুদ্ধে দায়ের করা রেকর্ড সংখ্যক ৫৩টি মামলার মধ্যে অন্তত পাঁচটির বাদী সরকার নিজে এবং বাকি মামলাগুলোও সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও সরকারি দলের নেতারা করেছেন। সরকারি অভিযোগের মধ্যে রয়েছে পুলিশের কর্তব্যকাজে বাধা, রাষ্ট্রদ্রোহ, ইসলামী জঙ্গিবাদে মদত দান, জালিয়াতি এবং বেশুমার ব্যক্তির মানহানি। আমাকে হয়তো ‘চান্স সম্পাদক’ বিবেচনা করেই আইপিআই’র নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গে আলোচনাকালে প্রধানমন্ত্রী এসব মামলাকে ধর্তব্যের মধ্যেই আনেননি। কিন্তু প্রবীণ সম্পাদক আবুল আসাদকে গাড়ি পোড়ানোর অবিশ্বাস্য অভিযোগে মধ্যরাতে বাসা থেকে এলিট বাহিনী র্যাব কর্তৃক গ্রেফতার এবং পরে রিমান্ডে পাঠানোর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর বেমালুম ভুলে যাওয়া বিস্ময়কর। অন্তত আবুল আসাদকে পেশাদার সম্পাদক মেনে না নেয়ার কোনো সুযোগ সম্ভবত মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার নেই। বয়সে আবুল আসাদের চেয়েও প্রবীণ, মনের দিক দিয়ে অবশ্য চিরসবুজ সাংবাদিক, সম্পাদক শফিক রেহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মানহানি মামলার বাদীর নাম আলহাজ্ব লায়ন মাওলানা মুহাম্মদ আবু বকর সিদ্দিক। ভদ্রলোক আওয়ামী লীগেরই অঙ্গসংগঠন আওয়ামী ওলামা লীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি।

শীর্ষ নিউজ ডট কমের সম্পাদক একরামুল হকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করা হয়েছে তার পত্রিকায় একজন মন্ত্রীর দুর্নীতির খবর প্রকাশের পর। মামলা দায়েরের আগে শীর্ষ কাগজের সাংবাদিকদের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছিল। চাঁদাবাজি মামলার ছুতো ধরেই তাকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতনের মুখে সাপ্তাহিক পত্রিকা এবং অনলাইন সংবাদমাধ্যম বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। সুতরাং, সম্পাদকদের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত প্রতিটি মানহানি কিংবা চাঁদাবাজি মামলার পেছনের কলকাঠি যে সরকারই নেড়েছে, এ নিয়ে জনমনে অন্তত কোনো সন্দেহ নেই। প্রধানমন্ত্রী অব্যাহতভাবে অসত্য দাবি করে যেতে পারেন, তবে দেশে-বিদেশে তার এসব কথা কেবল কৌতুকেরই সৃষ্টি করবে। তবে, এটা মানতে হবে যে রিমান্ডে নিয়ে পিটুনি দিলেও সরকার এখনো পর্যন্ত রাজধানীর কোনো পত্রিকা সম্পাদককে হত্যার মতো চরম পন্থা গ্রহণ করেনি। আমার ক্ষেত্রে ক্যান্টনমেন্ট থানায় একদল আততায়ী পাঠিয়েও অজানা কারণে নীতিনির্ধারকরা শেষ পর্যন্ত পিছিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন আমার ভাগ্য সহায় হলেও সাগর এবং রুনি খুনিদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি। এই তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল সাংবাদিক দম্পতি তাদেরই শয়নকক্ষে ছুরিকাঘাতে নৃশংসভাবে নিহত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হলে এবং শাসকশ্রেণীর মধ্যে সভ্যতার লেশমাত্র থাকলে এই কলঙ্কজনক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গোটা সরকার না হলেও অন্তত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এতদিনে পদত্যাগ করতেন। পাঠক বলতে পারেন বাংলাদেশের মন্ত্রীদের কাছ থেকে এতটা বিবেকবোধ আশা করা একপ্রকার ইউটোপিয়া। উল্টো এ দেশে হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ ও বিচার দাবি করার অপরাধে প্রধানমন্ত্রী এবং আদালতের কাছ থেকে গণমাধ্যমের কর্মীদের তিরস্কার শুনতে হচ্ছে। সাগর-রুনি হত্যার রহস্য উন্মোচন প্রক্রিয়ায় প্রশাসনের প্রতিটি মহল প্রথমাবধি রহস্যময় আচরণ করে চলেছে। এই বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের রথী-মহারথীরা গত প্রায় চার সপ্তাহে কে কী বলেছেন, তার একটা তালিকা জনস্বার্থেই প্রস্তুত করেছি, যাতে ভবিষ্যতে বিপদ বুঝে এরা আগের দেয়া বক্তব্য বেমালুম অস্বীকার করতে না পারেন।

* প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
সরকারের পক্ষে কারও বেডরুমে গিয়ে পাহারা দেয়া সম্ভব নয়। সাগর-রুনি তাদের বেডরুমে মারা গেছে। আমরা কি মানুষের বেডরুমে বেডরুমে পুলিশ বসাতে পারব?
* স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন
১. ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সাগর ও রুনির হত্যাকারীদের খুঁজে বের করা হবে।
২. মিডিয়ার চাপেই ৪৮ ঘণ্টার কথা বলেছি, এটি কৌশলও ছিল।
৩. আপনারা অপেক্ষা করুন, যে কোনো মুহূর্তে সুখবর শুনতে পারবেন।
৪. সাংবাদিক দম্পতি হত্যা-মামলা প্রধানমন্ত্রী নিজেই মনিটর করছেন।
৫. তদন্ত এগিয়ে গেছে, তদন্ত কর্মকর্তারা অতি দ্রুত একটি ভালো ফল দেবেন।
৬. সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের সুরাহা হবেই।
* সংসদ উপনেতা সাজেদা চৌধুরী
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকারীদের গ্রেফতারের জন্য প্রশাসনকে চাপ দিলে তারা ঘাবড়ে যেতে পারে।
* স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু
আইন-শৃঙ্খলা অবনতিসহ ঢাকায় সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জামায়াত-শিবির জড়িত রয়েছে।
* আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার
তদন্ত শেষ করতে না পারলেও প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। খুব শিগগির আপনাদের এ ব্যাপারে ইতিবাচক অগ্রগতির কথা জানাতে পারব।
* ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ
তদন্তের কাজ ডেডলাইন দিয়ে হয় না।
* মানবাধিকার কমিশন চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যার ব্যাপারে চাপ সৃষ্টি করলে তদন্ত ‘বিপথে’ যেতে পারে, তাড়াহুড়া করলে প্রকৃত অপরাধী ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেক্ষেত্রে জজ মিয়া নাটকের পুনরাবৃত্তি হতে পারে।
* ডিসি ডিবি মনিরুল ইসলাম
হত্যাকাণ্ডের মোটিভ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
* প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ
সমাজে যারা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, বিঘ্ন করতে চায় সামাজিক জীবন তাদের দ্বারাই এমন ঘটনা ঘটানো সম্ভব।
* প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী (মিডিয়া) মাহবুবুল আলম শাকিল
আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে থাকাকালে মেহেরুন রুনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে বিরোধী দলের সংবাদ কাভার করতেন। এজন্য প্রধানমন্ত্রী তাকে খুব স্নেহ করতেন।

সাগর-রুনির ভয়ঙ্কর হত্যার ঘটনাটিকে প্রশাসন প্রথমেই পরকীয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করার কৌশল গ্রহণ করে। জনমনে রুনি সম্পর্কে বিরূপ ধারণা দেয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন সরকারপন্থী পত্রিকায় সোত্সাহে তার চরিত্র হনন শুরু হয়। নিহত হওয়ার পূর্ব সপ্তাহে সে তার কোন ছেলেবন্ধুকে কতগুলো এসএমএস পাঠিয়েছে, মোবাইলে কতক্ষণ কথা বলেছে এসব কেচ্ছা-কাহিনী প্রকাশ পেতে থাকে সেইসব পত্র-পত্রিকায়। শুনেছি কাকের মাংস নাকি কাক খায় না। সাগর-রুনির ক্ষেত্রে দেখলাম একশ্রেণীর সাংবাদিক তাদের সহকর্মীদের মাংসভক্ষণ করতে যথেষ্ট আনন্দই পায়! রুচি বহির্ভূত এসব আদি রসাত্মক কাহিনী বিশেষ মহল থেকে আমাদের সাংবাদিককে গেলানোর চেষ্টা করা হলেও স্বাধীনতার কথা বলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আমার দেশ-কে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হয়নি। আমরা মহান সাংবাদিকতা পেশার সত্যনিষ্ঠতার প্রতি অবিচল থেকে প্রশাসনের দলবাজ কর্মকর্তাদের তদন্ত ভিন্নপথে ঘোরানোর অপচেষ্টা সম্পর্কে পাঠককে আগাম সতর্ক করেছি। রুনি ও সাগরের ব্যক্তিগত জীবনে উঁকি দেয়ার পরিবর্তে হত্যার রহস্য উদঘাটনকেই আমার দেশ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছে। হত্যা রহস্য উদঘাটনের দাবিতে সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে সর্বতোভাবে সমর্থন ও সহায়তা প্রদান করে গেছি। বিভিন্ন ব্লগে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সম্পৃক্ত করে অপ্রমাণিত বিভিন্ন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রকাশিত হলেও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নীতিতে অবিচল থেকে আমরা সেগুলোকেও সযতনে পরিহার করেছি। ব্লগে প্রচারিত ষড়যন্ত্রের গল্পগুলোর সঙ্গে বস্তুনিষ্ঠ প্রমাণ দেয়া থাকলে নির্দ্বিধায় আমার দেশ সেগুলো প্রকাশ করত। ভবিষ্যতে কোনো অনুসন্ধানী সাংবাদিক তথ্য-প্রমাণসহ সরকারের ওপর মহলের সেইসব ব্যক্তিদের এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার প্রমাণ দিতে পারলে অবশ্যই সেই কাহিনী প্রকাশ করা হবে।

এর মধ্যে সংবাদপত্র মালিকদের মধ্যকার এক ক্ষুদ্র সুশীল(?) গোষ্ঠীর এলিট সংগঠন নোয়াব এক বিবৃতি দিয়ে আমাদের হতবাক করেছে। সেই বিবৃতিতে তারা সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে কোনো অনুমাননির্ভর খবর না ছাপতে এবং দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে গণমাধ্যমের কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আজব কাণ্ড! পত্রিকার মালিকগোষ্ঠী কাদের উদ্দেশ করে বিবৃতি দিচ্ছেন? তারা স্ব স্ব পত্রিকায় এ বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ সম্পাদকীয় নীতি গ্রহণ করলেই এই সমস্যার উদ্ভব হতো না। তাছাড়া এই বিবৃতির মাধ্যমে মালিকরা স্বীকার করে নিলেন যে, তাদের পত্রিকায় দায়িত্বহীন আচরণ করা হয় এবং সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড ব্যতীত অন্যান্য সংবাদ পরিবেশনের বেলায় দায়িত্বশীলতার কোনো প্রয়োজন নেই। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো অনুমাননির্ভর সংবাদ ছাপা থেকে বিরত থাকার আহ্বান সংবলিত বিবৃতি দেয়া সত্ত্বেও গোয়েন্দা সংস্থা দ্বারা সরবরাহকৃত উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, অপ্রমাণিত সংবাদ নোয়াব-এর অন্তর্ভুক্ত পত্রিকাতেই নিয়মিত ছাপা হয়েছে এবং হচ্ছে। কথায় ও কাজে বিপরীতধর্মী আচরণ কেবল রাজনীতিকদের মধ্যে নয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের জাতীয় চরিত্রে পরিণত হয়েছে।

সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডে সর্বশেষ নাটকীয়তা আনয়নে মহামহিম আদালত বিশেষ ভূমিকা রেখেছেন। আদালতপাড়ায় সবিশেষ পরিচিত আওয়ামীপন্থী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোরশেদ বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার এক জনসভায় প্রদত্ত একটি বক্তব্য নিয়ে ভর্ত্সনার (Censure) উদ্দেশ্যে হাজির হয়েছিলেন বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের দ্বৈত বেঞ্চে। তার লক্ষ্য শতভাগ অর্জিত হয়েছে। হাইকোর্টের এই মাননীয় বিচারপতি বেগম খালেদা জিয়ার মন্তব্যকে এতই গর্হিত বিবেচনা করেছেন যে, তার সমালোচনা জানানোর উপযুক্ত ভাষা পর্যন্ত খুঁজে পাননি। হত্যারহস্য উন্মোচনে সরকারের যাবতীয় পদক্ষেপেও একই আদালত সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। শুধু তা-ই নয়, নাগরিকের বেডরুম পাহারা দেয়া বিষয়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরম বিতর্কিত বক্তব্যকেও সঠিক বিবেচনা করেছেন বহুল আলোচিত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী। বেগম খালেদা জিয়ার অপরাধ হলো, তিনি লালমনিরহাটের জনসভায় বলেছেন যে সাগর-রুনির কাছে সরকারের দুর্নীতির তথ্য থাকার কারণেই তাদের হত্যা করা হয়েছে। একজন রাজনীতিবিদ তার বক্তব্যে জনমতের প্রতিফলন ঘটাবেন, এটাই প্রত্যাশিত। বিএনপি চেয়ারপার্সনও তার বক্তৃতায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে যা বিশ্বাস করে, সেটাই নিজস্ব ভাষায় বিবৃত করেছেন। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর দ্বৈত বেঞ্চের দৃষ্টিতে অবশ্য সেই বক্তব্য অতীব গর্হিত বিবেচিত হয়েছে।

আদালত থেকে আরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে গণমাধ্যমে জজ মিয়া নাটক জাতীয় বাক্যাবলী আর লেখা যাবে না এবং তথ্যসচিব গণমাধ্যমের ওপর বিশেষ বেঞ্চ কর্তৃক আরোপিত এই সেন্সরশিপ দেখভাল করবেন। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে দীর্ঘদিন পর ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক নেতারা স্বাভাবিকভাবেই আদালতের নির্দেশে অতিশয় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। বিষয়টিকে তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর আঘাতরূপেই বিবেচনা করছেন। সাংবাদিক মহলে কট্টর আওয়ামীপন্থী নেতারূপে পরিচিত ইকবাল সোবহান চৌধুরী এবং মঞ্জুরুল আহসান বুলবুলের বক্তব্য এখানে বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেছেন, ‘পৃথিবীর কোথাও গণমাধ্যমের কাজে আদালতের এরকম হস্তক্ষেপের নজির নেই। আদালত কেন, কারও নির্দেশনা মেনে গণমাধ্যম দায়িত্ব পালন করবে না। হাইকোর্টের আদেশ অগ্রহণযোগ্য।’ আওয়ামীপন্থী বিএফইউজের সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী মার্চের ১ তারিখে সাংবাদিকদের দিনব্যাপী গণঅনশনে সভাপতির বক্তব্যে বলেছেন, ‘আদালতের নির্দেশনা অনভিপ্রেত ও অনাকাঙ্ক্ষিত। গণমাধ্যমের ওপর বিচার বিভাগের হস্তক্ষেপ সাংবাদিক সমাজ সহ্য করবে না। দু’একজন অবিবেচক বিচারপতির কারণে আদালত ও গণমাধ্যম যেন মুখোমুখি চলে না আসে, সেজন্য পদক্ষেপ নিতে প্রধান বিচারপতির কাছে আহ্বান জানাই।’ মনে হচ্ছে আসলেই বাংলাদেশে অনভিপ্রেতভাবে আদালত এবং গণমাধ্যম ক্রমেই মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। সাগর-রুনির হত্যার তদন্তের সংবাদ পরিবেশনা নিয়ে হাইকোর্টের রুল প্রসঙ্গে আরও একটি প্রশ্ন জনমনে উত্থাপিত হয়েছে। আমরা এতদিন জানতাম বিচারাধীন কোনো বিষয়ে লেখালেখি করা বাঞ্ছনীয় নয়। এখন থেকে কি তদন্তাধীন বিষয় নিয়েও সংবাদপত্রে লেখা বা গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলো? আইনের দৃষ্টিতে আদালতে বিচারাধীন এবং পুলিশের তদন্তাধীন বিষয় কি এক? তাছাড়া যে দেশের তথ্য আইনে জনগণের তথ্য জানার অধিকারকে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে, সে দেশেই অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সেন্সরশিপ আরোপের যে কোনো অপচেষ্টাই নিন্দনীয়। অতি উত্সাহী বাদী অ্যাডভোকেট মঞ্জিল মোরশেদ একটি স্পর্শকাতর বিষয়কে আদালতে টেনে নিয়ে অযথাই আদালতকে বিতর্কিত করলেন। এই আইনজীবীর মতো ব্যক্তিরা যে কখনোই আদালতের বন্ধু নন, সে বিষয়টি মাননীয় বিচারপতিরা যত দ্রুত বুঝবেন, ততই বিচার ব্যবস্থার জন্য মঙ্গল হবে।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এতসব ডামাডোলে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে নৃশংস ও আলোচিত হত্যাকাণ্ডটি ধামাচাপা পড়ার আশঙ্কাই জনমনে দৃঢ়তর হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতার করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আজ ২৬ দিন পার হয়ে গেলেও পুলিশ হত্যাকাণ্ডের কোনো কূল-কিনারা করতে সক্ষম হয়নি। আদালত প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট হতে পারেন, কিন্তু জনগণ যে একেবারেই সন্তুষ্ট হতে পারছে না এটাই বাস্তবতা। মানুষের মন আদালতের নির্দেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যে যায় না এ বিষয়টি সংশ্লিষ্টরা স্মরণে রাখলে ভালো করবেন। তরুণ সাংবাদিক দম্পতি সাগর ও রুনিকে তাদেরই শয়ন কক্ষে ঢুকে হত্যাকারীরা অত্যন্ত নির্মমভাবে যখন হত্যা করছিল, তখন পাশের ঘরে নিহতদের একমাত্র শিশুপুত্র মেঘ ঘুমিয়ে ছিল। সেই অবোধ, ঘুমন্ত শিশু জানতেও পারেনি গভীর নিশীথে তার কত বড় সর্বনাশ ঘটে গেছে। এই মানসিক আঘাত থেকে মেঘ কোনোদিন মুক্তি পাবে কিনা জানি না। ফ্যাসিবাদী মহাজোট সরকারের অধীনস্থ রাষ্ট্রযন্ত্রের সকল অংশ সম্মিলিতভাবে মেঘের নিহত পিতা-মাতাকে চরিত্রহননসহ অন্যান্য পন্থায় বড় নির্মমভাবে বার বার খুন করছে। মহান আল্লাহ্র কাছে প্রার্থনা করি যেন এই দুর্বিনীত শাসকশ্রেণীর ওপর তাঁর অভিসম্পাত বর্ষিত হয়।