Friday, March 2, 2012

একের পর এক নাটক সাজাচ্ছে পুলিশ – পরিবার

তদন্ত কর্মকর্তারা একবার বলছেন, তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে আবার বলছেন, উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই। একবার বলছেন, মোটিভ আর খুনি শনাক্ত। পরমুহূর্তেই বলছেন, এখনো তাঁরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত নন। কখনো বলছেন, হত্যাকাণ্ডের মোটিভ ব্যক্তিগত বা পারিবারিক, কখনো বা বলছেন, ডাকাতি বা চুরির ঘটনাও হতে পারে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একটি অংশ এ ধরনের অসংগতিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে এক 'রহস্য জাল' তৈরি করেছেন। ফলে নিহত দুজনের পরিবারসহ অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পুলিশ নানান নাটক সাজিয়ে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। খুনিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় পরিবারের সদস্যরাও মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন।

নিহত সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই ঘটনা ডাকাতি হতেই পারে না। মিথ্যাচার শুরু হয়েছে। তোমরা (সাংবাদিক) সজাগ থাকো। আগে ডাকাতির কোনো আলামত ছিল না এখন এলো কোথা থেকে? ডাকাতিই যদি ঘটে তবে ডাকাতরা কিভাবে এলো? গেলই বা কিভাবে? পুলিশ বলছে, আলামত নষ্ট হয়ে গেছে। তাহলে ওই বাসায় কারা গিয়ে আলামত নষ্ট করল? পুলিশ সেটা বের করতে পারছে না কেন? ভিসেরা টেস্ট কেন করা হয়নি? এত গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্তের কথা বলা হচ্ছে, অথচ তদন্তে আলামতই রাখা হয়নি। ঘটনার পর বলা হয়েছে বাসা থেকে কিছু খোয়া যায়নি অথচ এখন পুলিশ বলছে স্বর্ণ খোয়া গেছে। কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কিছু ঘোলাটে! এত দিন হয়ে গেল কোনো কিছু বের করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো নানান নাটক! আমরা কোথায় যাব? প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যায়বিচার চাই।'


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন সাবেক আইজি কালের কণ্ঠকে বলেন, এ রকম একটা ঘটনার পর পুলিশ সাংবাদিকদের নিয়ে বৈঠক করে তাঁদের সহযোগিতা চাইতে পারত। তদন্তে যাতে করে কোনো বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রেখে নিয়মিত ব্রিফিং দিয়ে একটা ভারসাম্য রাখতে পারত। তারা সেটা না করে গালগল্প ছড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। একেকজন একেক কথা বলছেন। এতে করে প্রকৃত ঘটনাটি আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। সৃৃষ্ট হয়েছে একটা ধূম্রজালের। কালের কণ্ঠের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমার কাছেও মনে হচ্ছে পুলিশ তামাশা করছে।'

সাগরের স্বজনরা জানান, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল সাগরের নবাবপুর রোডের বাসায় একবার গিয়েছিল। এরপর সাগরের স্বজনদের সঙ্গে তদন্তকারীরা আর যোগাযোগ করেনি। সাগরের পরিবার জানায়, বাসা কাছাকাছি হওয়ায় রুনির পরিবারের সঙ্গেই সাগর-রুনির যোগাযোগ বেশি ছিল। সাগর-রুনির দাম্পত্য সমস্যাসহ কোনো প্রকার সমস্যার কথাই জানা নেই তাঁদের। অথচ সংবাদমাধ্যমে এগুলোও আজ প্রচার পাচ্ছে।


একইভাবে নিহত রুনির ভাই এবং মামলার বাদী নওশের আলম রোমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁদের হতাশা দিনদিন বাড়ছে। তাঁরা বিস্মিত যে আজ পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করা দূরে থাক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ সম্পর্কেও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না। পুলিশ তাঁদের কিছু জানাচ্ছেও না। তাঁরা যেটুকু জানছেন সেটা প্রচারমাধ্যম থেকেই।


গতকাল যখন রোমানের সঙ্গে কথা হয় তখন তিনি নিহত দম্পতির ছেলে শিশু মেঘকে নিয়ে বসুন্ধরা সিটিতে ঘুরতে ও খেলনা কিনতে গিয়েছিলেন। টেলিফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় রোমান বলেন, মেঘও তার মা-বাবাকে খুব 'মিস' করছে। তার অনেক কথারই উত্তর দিতে পারেন না তাঁরা।


এক প্রশ্নের জবাবে রোমান বলেন, এটা কখনোই চুরি বা ডাকাতিজনিত ঘটনা হতে পারে না। তাঁদের আশঙ্কা, কোনো মহল প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। এ ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি না করে তিনি প্রকৃত রহস্য দ্রুত উদ্ঘাটনের জন্য পুলিশের প্রতি আন্তরিক আহ্বান জানিয়ে বলেন, হতাশার কারণে তাঁর মাসহ পরিবারের প্রতিটি সদস্যই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন।


নিহত সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা চলছে বলে জোরালো আশঙ্কা প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন,' আমরা শুধু আসল ঘটনা জানতে চাই। খুনি কে, দেখতে চাই।' সালেহা মনির কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরো বলেন, 'অনেক পত্রিকা যা খুশি তাই লিখছে। কিন্তু তোমরা (কালের কণ্ঠ) ভালোভাবে লিখছো। আজেবাজে কথা না লিখে প্রকৃত ঘটনা তোমরা বের করো। এখন তোমরা আমার সাগর। তোমাদের ভাইয়ের খুনিকে বের করো...।'


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের সাবেক ওই আইজি কালের কণ্ঠকে আরো বলেন, 'আমি নিজেই মনে করি না এটা ডাকাতি বা চুরিজনিত খুন। চোর বা ডাকাত কাউকে হাত-পা বেঁধে খুন করবে না। অপরাধবিজ্ঞান বা অপরাধের চলমান ধরন মতে, এটা করার কথা নয়। এটা কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডও হতে পারে না। যতটুকু জানি, সাগর আর রুনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ফলে কোনো রাজনৈতিক চাপও পুলিশের ওপর থাকার কথা নয়। কিন্তু সেই রকম কথাও পত্রিকান্তরে প্রকাশ পাচ্ছে। আমি মনে করি না, কোনো দলের শীর্ষপর্যায় থেকে আসছে নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ধরনের ঝুঁকি কেউ নেবে। এ অভিযোগ ঠিক নয় ধরে নিয়ে অন্তত এটুকু বিশ্বাস আর আস্থা রাখতে চাই। আর তাই আমি মনে করি, যদি সময়ও লাগে তবু একটি পরিপূর্ণ আর বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হওয়া উচিত। সেটা না হলে পুলিশ তাদের আস্থার অনেকটা জায়গা হারাবে।'

এ ব্যাপারে পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, কে কোনটা বিশ্বাস করবে কি করবে না, সেটা তদন্তের বিষয় নয়। ওটা মাথায় রেখে তদন্ত করা যায় না। তদন্ত হচ্ছে প্রকৃত ঘটনা বা সত্যকে বের করে আনা। তদন্তে যদি প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হয়, আর সেই সত্যটাও যদি বিশ্বাসযোগ্য না হয়, তখন কারই বা কি করার থাকে। সত্যকে মেনে নিতেই হবে।

আইজিপি আরো বলেন, এ ধরনের ঘটনা খুব একটা বেশি নয়, যেটা দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, সচিব, আইজিপি সার্বক্ষণিক তদারকি করেন। এ মামলার ক্ষেত্রে সেটাও করা হচ্ছে। ডিবির পাশাপাশি অন্য সংস্থাগুলোও এ ঘটনা নিয়ে তাদের মতো করে কাজ করছে। সবার একটাই উদ্দেশ্য, প্রকৃত সত্যকে খুঁজে বের করা। ফলে কারো মনে কোনো ধরনের সন্দেহ রাখার প্রয়োজন নেই। একটা আস্থার জায়গা তো মানুষের থাকতে হবে। তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই এই জোড়া খুনের রহস্য উন্মোচন হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, পুলিশের ওপর যে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ আগে হয়নি, তা নয়। তবে এই সরকারের আমলে পুলিশ যতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, এর আগে কখনো সেটা পারেনি। এ ধরনের ঘটনায় কারো কোনো চাপকে গ্রাহ্য করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে হ্যাঁ, চাপ আছে। সেটা হচ্ছে প্রকৃত খুনিদের খুঁজে বের করা। এটা শুধু ঊর্ধ্বতন মহলের নয়, এটা বিবেক আর দায়িত্বেরও চাপ। আর সেই চাপেই পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। আসলে আসামি গ্রেপ্তার করতে দেরি হওয়ার কারণেই এসব অভিযোগ উঠছে। ভিত্তিহীন হলেও এই মুহূর্তে এটা অস্বাভাবিক নয়। আদালতের নির্দেশ থাকায় এখন তাঁরা ইচ্ছা থাকলেও আর কোনো প্রেস ব্রিফিং করতে পারছেন না। কারণ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো তথ্যকেই আক্ষরিক অর্থে নিশ্চিত বলা চলে না। ফলে প্রচারমাধ্যমের কর্মীরাও তাঁদের ভুল বুঝছেন। তবে এটা সত্য, এই জোড়া খুনের ঘটনা জটিল আর স্পর্শকাতর হওয়ার কারণে প্রত্যাশার চেয়ে তাঁদের অনেক বেশি সময় লাগছে। আর এতেই সাধারণের মনে অনেক সন্দেহ দানা বাঁধছে। রহস্য বের হলেই সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে বলে তিনি জানান।

BY :  Parvez Khan. 

মিডিয়ার স্বাধীনতা - শেখ হাসিনা স্টাইল

বাংলাদেশের মিডিয়া এখন পুরোপুরি স্বাধীনতা ভোগ করছে। সরকার এর ওপর কোনো আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক সেন্সরশিপ আরোপ করেনি। গত তিন বছরে সরকার কোনো সাংবাদিক বা সম্পাদকের বিরুদ্ধে একটি মামলাও দায়ের করেনি।



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই দাবি করেছেন। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সফররত ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউটের (আইপিআই) নির্বাহী পরিচালক এলিসন বেথেল ম্যাকেঞ্জি তার দফতরে সাক্ষাত্ করতে গেলে তিনি বাংলাদেশের মিডিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে এ বক্তব্য দেন। প্রধানমন্ত্রী আইপিআই নির্বাহী পরিচালককে আরও জানান, তার সরকার সাংবাদিকদের হয়রানিতে বিশ্বাস করে না। গত বিএনপি সরকারের আমলে স্বাধীনতার পক্ষে ভূমিকা রাখার কারণে একটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল বলেও তিনি মন্তব্য করেন।



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন এক সময়ে এ বক্তব্যটি দিয়েছেন, যখন গোটা সাংবাদিক সমাজ ঐক্যবদ্ধভাবে রাজপথে আন্দোলনে রয়েছে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে গতকালও সাংবাদিকরা গণঅনশন কর্মসূচি পালন করেছেন। হাইকোর্টের একটি মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মিডিয়ায় সেন্সরশিপ আরোপ হতে পারে এ আশঙ্কায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে যুক্ত বিবৃতিও দিয়েছেন সাংবাদিকরা। গণঅনশন সমাবেশ থেকে তারা বলেছেন, কারও নির্দেশনায় গণমাধ্যম চলবে না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করা হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।



শুধু তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্যটি এমন সময়ে দিয়েছেন, যখন বাংলাদেশের মিডিয়া পরিস্থিতি নিয়ে শুধু দেশের ভেতরেই উদ্বেগ জানানো হচ্ছে না, বিদেশীরাও এ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন। কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে) সাংবাদিক দম্পতি হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছে, সাংবাদিকদের নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পৃথিবীর নিকৃষ্ট দেশগুলোর অন্যতম। একই ধরনের প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছে রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স, ইন্টারন্যাশনাল প্রেস অ্যাসোসিয়েশন, ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব জার্নালিস্টস ইন্টারন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ইত্যাদি আন্তর্জাতিক মিডিয়া ও মানবাধিকার সংগঠন।



সম্প্রতি ঢাকা সফর করে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী রবার্ট ও ব্লেক। তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, এনজিও, সুশীল সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে মতবিনিময় করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এরপর জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রেখেছেন। রবার্ট ও ব্লেক সংবাদ সম্মেলনে স্পষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যমের কাজের ক্ষেত্র সংকুচিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। তিনি স্বাধীন সাংবাদিকতার পরিবেশ নিশ্চিত করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন। 

সফররত আইপিআই নির্বাহী পরিচালক এলিসন বেথেল ম্যাকেঞ্জিও জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশে সাংবাদিক হত্যার কোনো বিচার না হওয়ায় আইপিআই উদ্বিগ্ন।


প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্য কতটুকু যৌক্তিক তা বিদেশী সংস্থা ও ব্যক্তিদের উপরের মূল্যায়ন থেকেই বোঝা যায়। তাছাড়া গত তিন বছরে যা ঘটেছে এ বিষয়ে অনুসন্ধান করলেই পুরো বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যায়। আসলে অনুসন্ধানেরও প্রয়োজন হয় না। গণমাধ্যম দলনের একের পর এক যে ঘটনা ঘটেছে, তা দেশের প্রতিটি মানুষেরই জানা। একটি শিশুকে প্রশ্ন করলেও অনায়াসে সে বলে দিতে পারবে সাংবাদিকরা কখন কীভাবে আক্রান্ত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকার মুখে স্বাধীনতার কথা বলে, বাস্তবে তাদের হাতে সবচেয়ে বেশি নিগৃহীত ও নির্যাতিত হচ্ছেন গণমাধ্যম কর্মীরা। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার, সম্পাদক ও সাংবাদিকদের গ্রেফতার, রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা, বিভিন্ন শ্রেণীর মিডিয়া বন্ধ করে দেয়া, কথায় কথায় মামলা ও লাঞ্ছিত করা এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে।



গত দুই বছরে জাতীয় পর্যায়ের তিনজন সম্পাদককে গ্রেফতার করা হয়েছে। শুধু গ্রেফতারই নয়, রিমান্ডে নিয়ে বর্বর কায়দায় নির্যাতন করা হয়েছে। শেখ হাসিনা সরকারের তিন বছরে ১৪ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। একটি হত্যাকাণ্ডেরও আজ পর্যন্ত বিচার হয়নি। 

মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের রিপোর্টেই দেখা যায়, ২০১১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারের তিন বছরে সাংবাদিকদের ওপর ৫২৯টি হামলা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১১ সালে সবচেয়ে বেশি ২০৬টি হামলা হয়েছে। এসব হামলায় এক হাজারেরও বেশি সাংবাদিক আহত হয়েছেন। কেউ কেউ পঙ্গুত্ববরণে বাধ্য হয়েছেন। অনেকে নিজ এলাকায় থাকতে পর্যন্ত পারছেন না, পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। চলতি বছরে আরটিভির রিপোর্টার অপর্ণা সেনের ওপর আওয়ামী লীগ এমপি কামাল মজুমদারের হামলা ও তাকে নাজেহাল করা আলোচিত একটি ঘটনা। তেমনি ঝিনাইদহ-৩ আসনের আওয়ামী লীগ এমপি শফিকুল আজম খানসহ দলের ক্যাডাররা গত ১৯ জানুয়ারি পিটিয়েছে স্থানীয় সাংবাদিক শহিদুল ইসলামকে। পুলিশ আশঙ্কাজনক অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সরকারদলীয় একজন পৌর মেয়রের আক্রমণে গুরুতর আহত হন আমার দেশ-এর ঝিনাইদহ প্রতিনিধি আরিফুল আবেদীন টিটো। বর্তমানে তিনি ঢাকায় পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন। এ ধরনের ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে।



প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কোনো সাংবাদিক বা সম্পাদকের ওপর একটি মামলাও দেয়া হয়নি। কথাটা তিনি কীভাবে বললেন? এটা কি নির্জলা মিথ্যাচার নয়? দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ৫৩টি মামলা দেয়া হয়েছে। এসব মামলা শুধু সরকারি দলের নেতা-কর্মীরাই দেননি, সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা, বিটিআরসির মতো সংস্থা এবং পুলিশের পক্ষ থেকে দায়ের করা হয়েছে। এক সরকারের আমলে একজন সম্পাদকের বিরুদ্ধে এতগুলো মামলার ঘটনা বাংলাদেশ সৃষ্টির ৪০ বছরের ইতিহাসে আর কোনো নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু তাই নয়, সাজানো মামলায় তাকে বর্বরোচিতভাবে দৈনিক আমার দেশ কার্যালয় থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে গিয়ে রিমান্ডে দিনের পর দিন নির্যাতন করা হয়েছে। আদালতে মাহমুদুর রহমান নিজেই তার বর্ণনা দিয়েছেন, সেগুলো নথিভুক্ত করা আছে। তাছাড়া তিনি তার 'জেল থেকে জেলে' বইয়েও সেগুলো সবিস্তারে লিখেছেন। গ্রেফতারের আগে তার প্রাণনাশের চেষ্টায় কয়েকবার হামলা চালানো হয়েছে। শুধু মাহমুদুর রহমানই নয়, ঊনসত্তর বছর বয়সী প্রবীণ খ্যাতিমান সম্পাদক আবুল আসাদকে একটি রাজনৈতিক দলের সংঘর্ষের ঘটনায় গ্রেফতার করে নির্যাতন করা হয়েছে। তাকে ৬ দিনের রিমান্ডের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছিল। অবশেষে সাংবাদিকদের হস্তক্ষেপে শেষ পর্যন্ত রিমান্ডে আর যেতে হয়নি। তেমনি দুর্নীতির রিপোর্ট লেখার কারণে শীর্ষ নিউজ ডট কমের সম্পাদক একরামুল হককেও গ্রেফতার করে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে।



মিডিয়া বন্ধ করার বড় নজির তো দৈনিক আমার দেশই। প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয় ও জ্বালানি উপদেষ্টার বিরুদ্ধে একটি অভিযোগের রিপোর্ট করার 'অপরাধে'(!) দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার ডিক্লারেশন বাতিল করে পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। শত শত পুলিশ পত্রিকা অফিসে ঢুকে সম্পাদককে গ্রেফতার এবং সাংবাদিকদের মারধর করে পত্রিকা অফিসে তালা ঝুলিয়ে দেয়, প্রেস সিলগালা করে দেয়া হয়। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দেয়া হয় সাজানো মামলা। এখনও সাংবাদিকদের এ মামলায় কোর্টের বারান্দায় বারান্দায় ঘুরতে হয়। ৪৭ দিন বন্ধ থাকার পর অবশেষে কোর্টের রায়ে আমার দেশ প্রকাশিত হচ্ছে। বেসরকারি টিভি চ্যানেল&mdashচ্যানেল ওয়ান এ সরকারই বন্ধ করে দিয়েছে।



এখন পর্যন্ত চ্যানেলটি পুনরায় চালুর কোনো অনুমতি দেয়া হয়নি। তেমনি শীর্ষ নিউজ ডট কম এবং শীর্ষ কাগজও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।



এ তো গেল মিডিয়া বন্ধের কথা। মিডিয়ার প্রতি সরকার কি আচরণ করছে, তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যেসব পত্র-পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল ভিন্নমত পোষণ করছে তাদের সঙ্গে সরকার বিমাতাসুলভ আচরণ করছে। দৈনিক আমার দেশ, দৈনিক নয়া দিগন্ত, দৈনিক সংগ্রাম এবং দৈনিক দিনকালকে সরকারি বিজ্ঞাপন দেয়া তিন বছর ধরেই বন্ধ। দৈনিক আমার দেশ প্রচার সংখ্যার দিক দিয়ে এখন চার নম্বর অবস্থানে রয়েছে। ইন্টারনেট পাঠক সংখ্যার দিক দিয়ে আমার দেশ-এর অবস্থান দ্বিতীয়, অর্থাত্ প্রথম আলোর পরেই। কিন্তু এই জনপ্রিয় পত্রিকাটিতে সরকারি বিজ্ঞাপন নেই। বছরে ৬০-৭০টি সরকারি ক্রোড়পত্র পত্রিকায় দেয়া হয়। কিন্তু আমার দেশ একটি ক্রোড়পত্রও পায় না। এমনকি সশস্ত্র বাহিনী দিবসের বিজ্ঞাপনটিও আমার দেশকে দেয়া হয়নি। শুধু বিজ্ঞাপনই নয়, সরকারি দাওয়াতের ক্ষেত্রেও ওই চার-পাঁচটি পত্রিকাকে অলিখিতভাবে কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কোনো ব্রিফিং হলে সেই ব্রিফিংয়ে আমার দেশসহ ওই পত্রিকাগুলোকে দাওয়াত দেয়া হয় না। সম্প্রতি ব্যর্থ সেনা ক্যু সম্পর্কে সেনা সদরে যে সংবাদ সম্মেলন আহ্বান করা হয়েছিল, সেখানে আমার দেশ, নয়া দিগন্ত, সংগ্রাম, দিনকাল এবং নিউএজকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। অথচ সংবাদ সম্মেলনে আমার দেশ-এর একটি খবর সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করা হয়, খবরটি সঠিক হওয়া সত্ত্বেও।


সম্প্রতি পুলিশের একজন দায়িত্বশীল ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমরা যা বলি সেটাই নোট করতে হবে। কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। অথচ সাংবাদিকরা প্রশ্ন করে করেই সত্য উদঘাটন করে থাকেন।



রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ফাঁসির আসামিদের দণ্ড মওকুফ করে দিয়েছেন। সেটা কেন মওকুফ করা হলো, জানার অধিকার এখন সাংবাদিকদের নেই।



প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি এবং সরকারি দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা পর্যন্ত তাদের স্বার্থের টোকা লাগলেই দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যথেচ্ছ ভাষা ব্যবহার করে আক্রমণ করছেন। জনসভা, সেমিনার, মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক এমনকি সংসদ অধিবেশনেও মিডিয়ার ওপর বিষোদগার করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ অক্টোবর মন্ত্রিসভার বৈঠকে মন্ত্রীদের উদ্দেশে বলেন, মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে কোনো পত্রিকা অসত্য সংবাদ প্রকাশ করলে ওই পত্রিকার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করুন। সাবধান করার পরিবর্তে মামলা করার কথা বলায় মন্ত্রীসহ দলীয় লোকেরা মিডিয়ার প্রতি অনৈতিক আচরণ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। কিছুদিন আগে নৌমন্ত্রী শাজাহান খান একটি পত্রিকার বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন খবরের অভিযোগে ১০ কোটি টাকা দাবি করে মামলা করেছেন। তিনি বলেছেন, ক্ষতিপূরণের এই টাকা পেলে তিনি নাকি সাংবাদিকদের শিক্ষিত করার জন্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট করবেন।


গত ৯ ডিসেম্বর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বেশকিছু মিডিয়া মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী গণভবনে কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের উদ্দেশে বক্তব্যে বলেন, মিডিয়া যা ইচ্ছা তা লিখছে।

কয়েক মাস আগে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিরক্ষাবিষয়ক উপদেষ্টা একটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিকের সম্পাদককে উদ্দেশ্য করে বলেন, চাইলেই আমরা ওই সম্পাদককে গ্রেফতার করতে পারি। একইভাবে সংসদেও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে সরকারের নীতি-নির্ধারক ও এমপিরা বক্তব্য দিয়েছেন।


একদিকে প্রধানমন্ত্রী ও সরকারদলীয় নেতারা অহরহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলতে দম পাচ্ছেন না, অন্যদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে বিষোদগারের পাশাপাশি মিডিয়া দলন চালানো হচ্ছে। সাংবাদিক নির্যাতনের নতুন রূপ দেখা যাচ্ছে। মারধর ও হত্যা করা হচ্ছে।



প্রধানমন্ত্রী বলছেন, আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো সেন্সরশিপ নেই। কিন্তু বেসরকারি টেলিভিশনের চ্যানেলগুলোর টকশো রোষানলে পড়েছে। টকশোতে যারাই সরকারের বিরুদ্ধে কড়া ভাষায় সমালোচনা করে বক্তব্য রাখছেন, অলিখিত আদেশ কিংবা অদৃশ্য ইঙ্গিতে দেখা যাচ্ছে তাকে আর টকশোতে ডাকা হচ্ছে না।


আইপিআই নির্বাহী পরিচালককে প্রধানমন্ত্রী জানান, বিগত বিএনপি সরকার একটি টিভি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু সারাদেশের মানুষ জানে, উচ্চ আদালত তথা হাইকোর্ট এবং পরবর্তীকালে আপিল বিভাগের রায়ে ইটিভি বন্ধ করা হয়েছিল।



আসলে আওয়ামী লীগ কখনোই মিডিয়ার স্বাধীনতাকে সহ্য করতে পারেনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন সরকার মাত্র চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল। সে সময় শত শত সাংবাদিক বেকার হয়ে পড়েছিলেন। ১৬ জুন এখনও সাংবাদিকরা কালো দিবস পালন করে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণকারী কালো আইনটিও ওই সময়ই করা হয়। তেমনি ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে দৈনিক বাংলা, টাইমস, বিচিত্রা ও আনন্দ বিচিত্রা বন্ধ করে দিয়ে পাঁচ শতাধিক পেশাজীবী সাংবাদিককে বেকার করে দেয়।

 সাংবাদিকদের ন্যায্য পাওনা নিয়েও তখন সরকার গড়িমসি করেছিল। প্রখ্যাত সাংবাদিক নির্মল সেন সাংবাদিকদের পাওনা আদায়ের জন্য টানা কয়েকদিন প্রেস ক্লাবে অনশন করেন। অনশনে তিনি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে পড়লে সরকার সাংবাদিকদের পাওনা পরিশোধে বাধ্য হয়। তারপরও পুরো টাকা এখনও অনেকেই পাননি। দৈনিক বাংলার সাংবাদিক হিসেবে সরকারের কাছে এখনও আমার দুই লাখ টাকা পাওনা রয়েছে।



এসব উদাহরণ থেকে এটাই পরিষ্কার যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আইপিআই নির্বাহী পরিচালকের সঙ্গে বৈঠকে যে বক্তব্য দিয়েছেন তা অসত্যই নয়, নির্জলা মিথ্যাচার।

BY  : Syed Abdal Ahmed.