Sunday, March 18, 2012

রুনী-সাগর হত্যাকাণ্ড: আদৌ কি তদন্ত চলছে?

১১ ফেব্রুয়ারী, সকাল আটটা। ঘুমের মধ্যেই ফোনটি ধরলাম। অপর প্রান্ত থেকে খুব চেনা একটি কন্ঠস্বর বললো, ‘শুনছেন, সাগর রুনি দুজনই আত্মহত্যা করছে কিংবা ডাকাতি হইছে। 
 
কিছু জানেন নাকি?’ মুহুর্তে চিত্কার করে উঠে বসলাম। ‘প্রভাষ দা? বুঝলাম না আপনার কথা।’ এটিএন নিউজের প্রধান বার্তা সম্পাদক প্রভাষ আমীন যা বললেন, তা এমন: মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি-এরা দুজনই মারা গেছেন। তবে সেটি আত্মহত্যা নাকি ডাকাতি নিশ্চিত নয়। আমি অবিশ্বাসের সুরে বললাম, ‘খোঁজ নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি।’ রুনির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বলে পরিচত এটিএন বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি নাদিরা কিরনকে ফোন করলাম। ধরা গলায় কিরন আপা বলেলন, ”সব শেষ!” আমি আর কিছু ভাবতে পারলাম না। বাসা থেকে বের হতে হতে আমার অফিস মাছরাঙার প্রধান বার্তা সম্পাদক রেজওয়ান হক রাজা ভাইকে ফোন করলাম এবং খবরটা নিশ্চিত করলাম।

সম্ভবত দশটা বেজে গেলো পশ্চিম রাজা বাজার পৌছাতে। ওই গলিতে ঢোকার পথে দেখলাম, ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের একটি গাড়িতে করে মেঘকে কোথা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আর উল্টোদিক থেকে প্রবেশ করছে সিআইডি’র ’ক্রাইম সিন’ গাড়ি। আমি বিনা বাধায় রুনি সাগরের পাঁচতলার ফ্লাটে উঠলাম। সেখানে তখন গমাধ্যমকর্মী, পুলিশ এবং রুনি সাগরের অল্প সংখ্যক আত্মী-স্বজনে ঠাসা। সবার চোখে অবিশ্বাস, যেনো যা ঘটেছে তা নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হচ্ছেনা কারো! যে রুমে হত্যাকান্ড হয়েছে সেই বেড রুমটি বন্ধ, ভেতরে পুলিশ কর্মর্তারা। রুনি সাগরের মৃতদেহ তখনো সেখানে। আলামত সংরক্ষন হচ্ছে। ওই রুমের সামনেই ডাইনিং স্পেসটিসহ রুমটি সিআইডি’র ক্রাইম সিন জোন’ ফিতা লাগানো। তাই শত চেষ্টা করেও দেখতে পারিনি ভেতরের অবস্থা। এরই মধ্যে একজন বললেন, রান্না ঘরের গ্রিলটি কাটা। আরেকজন বললেন, ওখান দিয়ে ছোট বাচ্চা ঢুকতে পারবে না। ‘মনে হয় আগে ছোট বাচ্চা ঢুকিয়ে দিয়ে ঘরের দরজা খুলেছে।’ উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিকের এসব মন্তব্য শুনতে শুনতে আমি রান্না ঘরে গেলাম, সেখানে তখন সিআইডি’র বহুল আলোচিত কর্মকর্তা আব্দুল কাহার আখন্দ। তাকে ওই কাটা অংশটি দেখিয়ে সাদা পোষাকের এক কর্মকর্তা বললেন, এখান থেকে কিভাবে ঢুকবে? কাহার আখন্দ কাটা অংশটি মনোযোগ দিয়ে দেখলেন, গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে নিচে কিছু দেখতে চাইলেন। তার মনোভাব বোঝা গেলোনা। আমি জানতে চাইলাম, তিনি মাথা নাড়তে নাড়তে ’দেখি’ বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি গ্রিলের কাটা অংশটি দেখলাম, ভালো করে। আটি ইঞ্চি মতো বর্গাকার ফাঁকা দিয়ে কোন্ও প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পক্ষে প্রবেশ করা সম্ভব কি না অনুমান করতে পারলাম না। মাথাই ঢুকবেনা’ কানে আসলো এক সহকর্মীর মন্তব্য। আমি চুলার দিকে তাকালাম। শূন্য দুই চুলার মাঝখানে একটি ফ্রাইপ্যান, দুটি ডিমের খোসা, অগোছালো টুকটাক জিনিসপত্র, ছড়ানো ছিটানো।

পরের দিন মেঘের কাছে শুনেছি, ‘দুইটা চোল (চোর) আমার ডিম খেয়ে ফেলছে। তিনটা ডিম ছিলো। আমার বাবাকে মেরেছে। আমাকে গুলি করতে চেয়েছিলো। গুলির মধ্যে ব্যাটারি লাগানো তাতে ছোট লাইট জ্বলছে ।” মেঘের সঙ্গে এ বিষয়ে আমার একবারই কথা হয়েছে, এবং তা দিয়ে একটি নিছক মানবিক আবেদনময়ী রিপোর্ট প্রচাররিত হয় মাছরাঙা টেলিভিশনে।সেই রিপোর্টের কারনে আমি অনেক সমালোচিত হয়েছি। মেঘের ওই মানসিক অবস্থায় বাবা-মার মৃত্যু নিয়ে কথা বলা কতটা সঠিক ছিলো সেই বিতর্কে যাবোনা; তবে সব সমালোচনা মাথা পেতে নিয়েছি। মেঘ শিশুসুলভ এলোমেলো ভাবে বারবারই বলেছে, চোর ওর বাবাকে মেরেছে।মাকে আগে মেরেছে, পরে বাবাকে মেরেছে। রান্না ঘর থেকে চলে গেছে। নানুকে ফোন করে বলেছি, মিম্মি (মা)বাবা মরে গেছে।” আমি প্রশ্ন করেছিলাম, ওদেরকে চেনো? মেঘ না বোধক মাথা নেড়েছে, মুখে বলেছে, ‘ওদের নামটা জানিনা’।

রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে সিড়িতে হতবিহ্বল সহকর্মীদের পাশে এসে দাড়ালাম। মনের ভেতর অনেক ভাঙ্গচুর, অসংখ্য প্রশ্ন। দু’টি জ্বলজ্যান্ত মানুষ ভেতরে মরে পড়ে আছে, কিন্তু কেউই বলতে পারছে না ঠিক কী ঘটেছে সেখানে। কানে আসতে লাগলো মৃদু গুঞ্জন। মেঘ নাকি কাকে বলেছে, ওদেরকে পিকনিকে দেখেছে . . . রুনি-সাগর ভাইয়ের কোন্ও শত্রু থাকতে পারে, এটাই বিশ্বাস করা যায়না, সেখানে এতো বড় চেনাজানা শত্রু যারা, তারা এতোটা নির্মম-নৃশংসভাবে হত্যা করবে!.কিছুই মাথায় আসেনা।

শূন্যতায় হাতড়াচ্ছি, এমন সময় দেখলাম সাগর সরোয়ারের আম্মা এবং বোন ‘আমার বাবু’ আমার সাগর রুনি’ বলে কাঁদতে কাঁদতে চারতলা সিড়ি দিয়ে উঠছেন। সাগর ভাইয়ের আম্মাকে ধরে নিয়ে গেলাম ভেতরে, রান্না ঘর লাগোয়া একটি রুমে, সম্ভবত রিডিং রুম। কিছুটা ফাঁকা ওই রুমে একটি টেবিল, বুকসেলফ—তবে কোনও চেয়ার ছিল না। কিছুক্ষন পরই সেখানে এলেন ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ। সাগর ভাইয়ের আম্মা তাকে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, আমার একটাই ছেলে, আমার এইটাই বাবু. পুলিশ কমিশনারের মুখে কোন্ও কথা ছিলোনা। ‘আমরা দেখছি, আমরা দেখছি’ বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। ঢুকলেন রুনির আম্মা। তাকে আগেই দেখেছিলাম, বসার ঘরে, ঘটনার আকস্মিকতায় তার চেহারায় ফুটেছিলো ভাবলেশ-বোধহীন গভীর শূন্যতা। জিজ্ঞেস করলাম, কি ঘটতে পারে?কিছু জানেন কিনা? কিছুটা অস্পষ্ট এবং স্বভাবসুলভ দ্রুতিগতিতে যা বললেন, তার ভাবার্থ: তিনি কিছুই বুঝতে পারছেননা। কখন কিভাবে খবর পেলেন? বললেন, সকাল সাতটার দিকে মেঘ তাকে ফোন করে। কিন্তু লাইনটি কেটে যায়। তিনি কলব্যাক করলে মেঘ ফোন ধরে জানায়, আম্মা, (মেঘ নানীকে আম্মা ডাকে) বাবা মা দুজনই মরে গেছে। মেঘের কন্ঠস্বর তার কাছে অস্বাভাবিক লাগে। ছুটে আসেন ‍রুনির ফ্লাটে, দরজা খুলে দেয় মেঘ। পরের দিন মেঘ আমাকে বলেছে, সে নিজেই দরজা খুলেছে। চোর যায়ার পর কি তুমি দরোজা বন্ধ করেছিলে? মেঘ বলেছে, ওরা জানালা ভেঙ্গে ফেলেছে।

রুনির আম্মার সঙ্গে কথা শেষ করে এসে দাড়ালাম ‘ক্রাইম সিন জোন’ ফিতার সামনে। ফিতার ওপারে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাদা পোষাকের লোকজন। এপারে সংবাদমাধ্যমের কর্মীরা।তখন সম্ভবত বেলা সাড়ে এগারোটা কি বারোটা হবে। হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হওয়ার রুমে তখনো পুলিশ। ফিতার ওপারে যাওয়ার একটু চেষ্টা করলাম, পুলিশের অনুরোধে ফিরে এলাম। এখন যখন পুলিশ আলামত নষ্ট হওয়ার কথা বলে, ভেবে পাইনা, পুলিশ তখন অতো দীর্ঘ সময় ভেতরে কি করেছিলো? পুলিশের উচু পদস্থ, অ-পদস্থ কমবেশি সবাই ওই রুমে ঢুকেছেন, কোনও গমাধ্যমকর্মীকে আমি ভেতরে ঢুকতে দেখিনি। এমনকি সাগর রুনির মৃতদেহ’র ফুটেজ মাছরাঙাসহ কয়েকটি চ্যানেল সবার আগে পৌছানো দু’ একটি চ্যানেল থেকে সংগ্রহ করেছিলো। আমি সেই ফুটেজেই দেখেছি ওই রুমের অবস্থা। হাত পা বাধা সাগর ভাই, আর বিছানা ঘেঁষে একটু বেকে থাকা রুনির মৃতদেহ। ওই ফুটেজটি ভালো করে দেখলে বোঝা যায় সেটি দরজার সামনে থেকে তোলা। 

পুলিশ সম্ভবত আটটা সোয়া আটটা নাগাদ ঘটনাস্থলে পৌছায় রুনীর ভাই ন্ওশের রোমানও তখনই পৌছায়। রোমান বলেছে, সে ও ওই রুমে ঢোকেনি। এমনকি ততক্ষনাত ঘটনাস্থলে পৌছানো কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তারা দরজার সামনে থেকে দেখেছেন, ভেতরে প্রবেশ করেননি। প্রশ্ন ওঠে, তাহলে আলামত নষ্ট হলো কি করে? করলোইবা কে? আলামতের কয়েকটি মৌলিক বিষয় রয়েছে, ‘সাধারন মানুষ কখনো রক্তের ওপর পা রাখেনা। কিন্তু খুনী রক্তের ওপর তার ছাপ রেখেই যায়, কেনো যেনো খেয়াল করতে পারেনা,’ নিজের ৩৫ বছরের অভিজ্ঞতা দিয়ে কথাটি বলছিলেন সিআইডির সাবেক কর্মকর্তা খালেকুজ্জামান, পিপিএম। তিনি বলছিলেন, ‘পুলিশ কি আলামত চায়? এখন তো রিকসা ওয়ালাও স্যান্ডেল পরে। ধরে নিতে পারি খুনি জুতা পরেছিলো, তাই ফুটপ্রিন্ট পাওয়া যাবেনা ঘটনার দুদিন পর কথা হয়েছিলো খালেকুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি আরও বলেন, ‘হত্যাকারীরা পেশাদার ভাড়াটে খুনী, তা না হলে শিশুটিকে হত্যা করতো। সাধারন মানুষ হলে শিশুটি প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী ভেবে ভয় পেয়ে হত্যা করতো। তাহলে এই হত্যাকাণ্ডের মটিভ কী হতে পারে- এর জাবাবে খালেকুজ্জামান পাল্টা প্রশ্ন করেন,
ওই বাসার দুটি ল্যাপটপের একটি নষ্ট, সেটি রেখে গিয়ে খুনী ভালোটি নিয়ে গেলো, কেন? তারা চেক করলো কখন? চোর ডাকাতদের তো এতো সময় থাকার কথা নয়!

চোর ডাকাত কি ল্যাপটপ নিতে পারেনা? 

পারে, তবে সেক্ষেত্রে তারা দু’টোই নিতো।

সাগোর সরোয়ারের দুটি মোবাইল ফোনের মধ্যে ব্যক্তিগত মোবাইলটি নিয়ে গেলো, অফিসেরটিসহ রুনির মোবাইলও রেখে গেলো, কেন?

চাঞ্চল্যকর অনেক হত্যা রহস্যের জট খোলা এই গোয়েন্দা নিজেই প্রশ্ন করেন, নিজেই জবাব দেন খুনীদের আক্রোশ সাগরের ওপর, যে কারনে তাকে এতো আঘাত করা হয়েছে, হাতপা বেধে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতে পারে, তারা যা চায় তা তার ল্যাপটপে সংরক্ষিত থাকতে পারে
 
ফিরে আসি ঘটনার দিনে। ক্রাইম সিন জোন ফিতা থেকে নিজেকে সরিয়ে আবার ফিরে এলাম সিড়িতে। কেউ একজন কানের কাছে ফিসফিস করলো, রুনির ভাইকে এরেষ্ট করেছে।’ পরে শুনেছি, ওকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ডেকেছিলো, ছেড়েও দিয়েছে।আমি সিড়ি বেয়ে একেবারে নিচে নিমে এলাম। পার্কিং এ দাড়ালাম সাবেক কয়েকজন সিনিয়র সহকর্মীর সঙ্গে। হঠাত দেখি বিভিন্ন চ্যানেলের রিপোর্টার ঘিরে ধরেছে ডিসি সাউথ ইমাম হোসেনকে। সেদিন আমি কোন্ও পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে যাই নি। তবু এগিয়ে গেলাম। তিনি বললেন, ‘প্রাথমিক ভাবে ধারনা করা হচ্ছে হত্যাকারীরা পূর্ব পরিচিত’।
 
পুরনো সহকর্মীদের কাছে আবার ফিরে এলাম। সবর্ত্র তখন জ্বল্পনা-কল্পনা। রোপিত হচ্ছে গুজবের বীজ।

তখন সম্ভবত দেড়টা, ময়না তদন্তের জন্য সাদা প্যাকেটে মোড়ানো সাগর ভাই রুনিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। ঝাপসা চোখে স্লাইড শো’র মতো ভেসে ভেসে উঠলো রুনী সাগর ভাইয়ের স্মৃতি।যতবার মেঘের কথা ভাবি, মেঘের চেহারা ছাপিয়ে চোখে ভেসে ওঠে সমবয়সী আমার ছেলেটির মুখ। শূন্যতায় ভর করে ফিরে আসি বাসায়। একটু দম নিতে। আমার সন্তানটিকে একটু বুকে জড়িয়ে ধরতে। চারটার দিকে গেলাম আমার অফিসে। অনুরোধ আর নিজের চেষ্টা সত্ত্বেও আমি কোনও রিপোর্ট বানাতে পারলাম না। নির্দ্বিধায় স্বীকার করি, ওইদিন বুঝলাম, যতটা পেশাদার নিজেকে মনে করি, ততটা আমি নই।

সন্ধ্যার পর থেকে একটু পরপরই আমার মোবাইলটি বেজে ওঠে। গমাধ্যমকর্মীদের জড়িয়ে গুজব ছড়াতে থাকে। এখন এর নাম তো, একটু পর আরেকজনের নাম। সেই নামগুলোর মানুষরা এমন নৃশংশ ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকতে পারে, তা কল্পনায়ও আনা যায়না। নাম গুলো এসেছে ‘হত্যাকারীরা পূর্ব পরিচিত’ পুলিশের এই মন্তব্যের সঙ্গে সামর্থিক ভাবে মেঘের বক্তব্য ‘ওদেরেকে পিকনিকে দেখেছি’। তবে জিজ্ঞাসা সত্ত্বেও মেঘ আমাকে এমন কোনও কথা বলেনি।

সারারাত ঘুমোতে পারিনি। সকালে বের হলাম হত্যাকাণ্ডের ফলোআপ রিপোর্ট করতে। তখন সম্ভবত সকালে সাড়ে নটা। রুনি সাগর ভাইয়ের পাঁচতলা ফ্লাটে ঢুকতে ঢুকতে কানে এলো একটি কন্ঠস্বর, ‘চল্লিশ সেকেন্ড কথা বলে ফোনটা ওখানেই রেখে দেয়াটা অস্বাভাবিক’, নিজেরা নিজেরা কথা বলছিলেন পুলিশের একজন আরেকজনের সাথে। পরে বুঝলাম কন্ঠস্বরটি ছিলো ডিসি সাউথ ইমাম হোসেনের। সঙ্গে ছিলেন দুজন সিআইডি কর্মকর্তা, শের--বাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং আরও দু’ জন। তারা আমার সঙ্গে কোন কথাই বলতে চাইলেননা। অভিযোগ তুললেন, সাংবাদিকদের জন্য তাদের কাজে ধীরগতি হচ্ছে

আমি ফ্লাট থেকে বেরিয়ে সিড়িতে দাড়ালাম। কী করবো ভাবছি। এরইমধ্যে মেঘকে নিয়ে এলো রুনির তিন ভাই ও আম্মা। তখনই কথা হলো মেঘের সঙ্গে। জানলাম, মেঘ সারারাত ঘুমায়নি। অসুস্থ হয়ে পড়েছে। কথা বলছে এলোমেলো।’ যা ছিলো ওই দিনের রিপোর্টের হেড লাইন।ওই দিনই মেঘের সঙ্গে দেখা করতে আসেন ওর স্কুলের শিক্ষকরা। এডিট প্যানেলে বসে মেঘের একটি শব্দ কানে লাগে। বারবার ফুটেজটি রিপিট করে দেখি। অস্পষ্টভাবে মেঘ ওর শিক্ষককে বলছে গলায় অনেক ব্যাথা। পরে মেঘের গলার ছবিটি ভালো করে দেখি। সেখানে গভীর কালশিটে দাগ। নখ বসানো। ফোন করি রোমানকে। জানলাম, খুনীরা মেঘকেও নির্যাতন করেছে, তার টুটি চেপে ধরেছে। চুল টেনেছে এবং পুরুষাঙ্গে আঘাত করেছে। খুনীদের একজনের হাতের নখ বড় বড় যার দাগ বসে আছে মেঘের গলায়।

১২ এবং ১৩ ফেব্রুয়ারী সাংবাদিকদের জড়িয়ে শুরু হলো গুজবের উন্মাদনা। এমনকি রুনির পরকিয়া প্রেমের গালগল্প। আমি মেলাতে পারিনা। কারন রুনিকে নিয়ে কোনদিন এমন ’গসিপ’ কখনোই শুনিনি। তাছাড়া অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনও ঘটনার কুলকিনারা না পেলে পুলিশ পরকিয়া প্রেমের গল্প ফাদে। আর এতো আপত্য প্রেম যে দুজনকেই মেরে ফেলতে হবে! অযৌক্তিক লাগে। কিন্তু কেউ কাউকে অকারনে হত্যা করেনা, তা ও আবার পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনে অভ্যস্ত এমন অমায়িক দুজন মানুষকে! এরইমধ্যে জানলাম সাগর ভাইয়ের একটি বইয়ের কথা, ‘কর্ণেলকে আমি মনে রেখেছি’। বইটি গত বছর বই মেলায় প্রকাশ করে ভাষাচিত্র। বইটি সংগ্রহ করে পড়লাম। শান্তিচুক্তির পর পাবর্ত্য চট্টগ্রাম ইস্যুতে লেখা অত্যন্ত স্পর্শ কাতর বইটি। এতে উঠে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে কারা সমস্যা জিইয়ে রেখেছে, কারা তাদের অর্থ ও অস্ত্র দেয়-এমন তথ্য। এসব বিষয়ের দু একটি অংশ এখানে তুলে ধরছি: 

কলিমুল্লার (রহিঙ্গা গেরিলা নেতা) কোমরে একটি পিস্তল। ছোটখাট ছিমছাম। আমার তাকানোর ভঙ্গি দেখে সে বুঝে নিলো প্রশ্ন। বললো,

এটি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে পাওয়া। গিফট। 

কোন সেনাবাহিনী?

বুঝে নিন।

আমি বুঝতে পালাম। অনেক কিছুই আমাকে বুঝে নিতে হয়। 

আপনারা কি ধরনের অস্ত্র পান?

যখন যে ধরনের অস্ত্র প্রয়োজন। 

চাইলেই পান?

চাইলেই পাই। যখন প্রয়োজন খবর দেই। জায়গা ঠিক থাকে। ওখানে রেখে দেয়া হয়। গুনে নেই, ‍গুনে দেই। তবে গুলির কোন হিসাব থাকেনা। 

যোগাযোগ কি করে হয়?

ওয়ারলেস। আমরা এমন একটি ফ্রিকোন্সে ব্যবহার করি যা কেউ জানেনা।

মানে সেনাবাহিনী্ও না?

বাবা তো ছেলের জন্ম তারিখ ঠিকই জানে, তাইনা!

উত্তর পেয়ে গেলাম।

ওই রিপোর্টের শিরোনাম দিলাম-সেনা সহায়তায় মিয়ানমারের গেরিলারা বাংলাদেশে।

আমার এক সোর্সকে কয়েকদিন আগে জীবন দিতে হয়েছে। তিনি কোন দলে ছিলেন জানিনা। তবে তাকে বাচিয়ে রাখাটা তিনপক্ষের জন্যই ছিলো বেশ ঝুকিপূর্ন। সব খবর তার কাছে আপনাআপনি চলে আসতো। কেবল আসেনি তাকে মেরে ফেলার পরিকল্পনার খবরটি

মূলত: ৭১ পৃষ্ঠার এই বইটিতে সাগর সরোয়ার অনেক চিঠিপত্র, ডায়েরির উল্লেখ করেছেন- যা তার কাছে সংরক্ষিত আছে,সহকর্মী শামীম আরা শিউলিকে বইয়ের একটি কপি সাগর ভাই উপহার দেয়ার সময় এমন তথ্য শেয়ার করেন। সেই সূত্র ধরেই অনেক অজানা তথ্য উপাত্ত এবং নথিপত্র তার সংগ্রহে থাকার কথা-জানিয়েছেন শিউলি
 
হত্যা রহস্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানলাম, সাগর ভাই একই ইস্যুতে আরেকটি বই লিখছিলেন যা এ বছর বইমেলায় প্রকাশ হওয়ার কথা। এরজন্য তিনি অফিসে ছুটি চেয়েছিলেন। কিন্তু লোকবলের অভাবের কারনে মাছরাঙা তাকে ছুটি দিতে পারেনি। বইটি সম্পর্কে মাছরাঙার স্টাফ রিপোর্টার মাযহার মিলনকে সাগর ভাই বলেছেন, এবার বোমা ফাটাবো। তখন জানবে সাগর সরোয়ার কী জানে আর কী লিখতে পারে

ধারনা করছি, ল্যাপটপেই থাকার কথা তার ওই বইয়ের পান্ডুলিপি।

প্রশ্ন জাগে, যে বইটি তিনি মাত্র গত বছরই মেলায় এনেছেন, তার দ্বিতীয় পর্ব লেখার প্রয়োজন হল কেন? তার কাছে কি নতুন কোনও তথ্য ছিলো? কি হতে পারে তা? তা কি কাউকে সংক্ষুব্দ করতে পারে? উত্তর জানা নেই।তবে পাহাড়ে ছিলো সাগর সরোয়ারের দীর্ঘ দিনের বিশ্বস্ত সোর্স। রিপোটিং ছেড়ে দিলেও সাগোর ভাই সেই সম্পর্কগুলো মেইনটেইন করতেন।

পুলিশ বা তদন্ত কর্মকর্তারা এই দিকে কতটা নজর দিয়েছেন, আমার সন্দেহ আছে। কারন আমি নিজে কয়েকদফা এ বিষয়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছি। উত্তর পেয়েছি দায়সারা গোছের। এমনকি পান্ডুলিপিটি উদ্ধারের জন্য তার ইমেইল এড্রেস এ খোজ করা হয়েছে কিনা, তেমন সদুত্তর পাইনি।

পুলিশ এখন ঘটনাটিকে ‌‌ডাকাতি’ হিসাবে দেখাতে সব ব্যবস্থা প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছে। যদি পুলিশের কথা বিশ্বাস করি, তবে তাদের দক্ষতা নিয়ে শুধূ প্রশ্ন নয়, পুলিশের ‘প’ জানেন কিনা সন্দেহ জাগতে পারে। কারন ঘটনার দিন আব্দুল কাহার আখন্দসহ বাঘা বাঘা কর্মকর্তারা দীর্ঘ সময় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে কী বুঝেছিলেন? আমার মনে আছে, তিন দিন পর রুনির আম্মাকে ডেকে পাঠানো হয় বাসা থেকে কিছু খোয়া গেছে কিনা জানতে। তখনই জানা গেলো রুনির গয়না নেই। ঘটনার দশ দিন পর পুলিশ ওই পরিবারের কাছে জানতে চেয়েছিলো, সাগর সরোয়ারের ল্যাপটপের রঙ। ঘটনার দিন থেকে যেসব গুজব বেরিয়েছে তা সাংবাদিকরা ছড়িয়েছে সত্য, তবে প্রতিটি গুজবের পেছনে রয়েছে কখনো পুলিশের ইঙ্গিত, কখনো তাদের রহস্যময় নিরবতা। এসব কিসের ইঙ্গিত? তাদের অদক্ষতার? নাকি ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চক্রান্ত?