Friday, March 2, 2012

একের পর এক নাটক সাজাচ্ছে পুলিশ – পরিবার

তদন্ত কর্মকর্তারা একবার বলছেন, তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে আবার বলছেন, উল্লেখযোগ্য কিছুই নেই। একবার বলছেন, মোটিভ আর খুনি শনাক্ত। পরমুহূর্তেই বলছেন, এখনো তাঁরা এ ব্যাপারে নিশ্চিত নন। কখনো বলছেন, হত্যাকাণ্ডের মোটিভ ব্যক্তিগত বা পারিবারিক, কখনো বা বলছেন, ডাকাতি বা চুরির ঘটনাও হতে পারে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড নিয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের একটি অংশ এ ধরনের অসংগতিপূর্ণ বক্তব্য দিয়ে এক 'রহস্য জাল' তৈরি করেছেন। ফলে নিহত দুজনের পরিবারসহ অনেকেই আশঙ্কা করছেন, পুলিশ নানান নাটক সাজিয়ে প্রকৃত ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। খুনিরা গ্রেপ্তার না হওয়ায় পরিবারের সদস্যরাও মানসিকভাবে আরো বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছেন।

নিহত সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির গতকাল বৃহস্পতিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এই ঘটনা ডাকাতি হতেই পারে না। মিথ্যাচার শুরু হয়েছে। তোমরা (সাংবাদিক) সজাগ থাকো। আগে ডাকাতির কোনো আলামত ছিল না এখন এলো কোথা থেকে? ডাকাতিই যদি ঘটে তবে ডাকাতরা কিভাবে এলো? গেলই বা কিভাবে? পুলিশ বলছে, আলামত নষ্ট হয়ে গেছে। তাহলে ওই বাসায় কারা গিয়ে আলামত নষ্ট করল? পুলিশ সেটা বের করতে পারছে না কেন? ভিসেরা টেস্ট কেন করা হয়নি? এত গুরুত্ব দিয়ে মামলাটির তদন্তের কথা বলা হচ্ছে, অথচ তদন্তে আলামতই রাখা হয়নি। ঘটনার পর বলা হয়েছে বাসা থেকে কিছু খোয়া যায়নি অথচ এখন পুলিশ বলছে স্বর্ণ খোয়া গেছে। কিছুই বুঝতে পারছি না। সব কিছু ঘোলাটে! এত দিন হয়ে গেল কোনো কিছু বের করতে পারেনি পুলিশ। উল্টো নানান নাটক! আমরা কোথায় যাব? প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যায়বিচার চাই।'


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের একজন সাবেক আইজি কালের কণ্ঠকে বলেন, এ রকম একটা ঘটনার পর পুলিশ সাংবাদিকদের নিয়ে বৈঠক করে তাঁদের সহযোগিতা চাইতে পারত। তদন্তে যাতে করে কোনো বিঘ্ন না ঘটে সেদিকে খেয়াল রেখে নিয়মিত ব্রিফিং দিয়ে একটা ভারসাম্য রাখতে পারত। তারা সেটা না করে গালগল্প ছড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। একেকজন একেক কথা বলছেন। এতে করে প্রকৃত ঘটনাটি আড়ালে পড়ে যাচ্ছে। সৃৃষ্ট হয়েছে একটা ধূম্রজালের। কালের কণ্ঠের একটি প্রতিবেদনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমার কাছেও মনে হচ্ছে পুলিশ তামাশা করছে।'

সাগরের স্বজনরা জানান, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল সাগরের নবাবপুর রোডের বাসায় একবার গিয়েছিল। এরপর সাগরের স্বজনদের সঙ্গে তদন্তকারীরা আর যোগাযোগ করেনি। সাগরের পরিবার জানায়, বাসা কাছাকাছি হওয়ায় রুনির পরিবারের সঙ্গেই সাগর-রুনির যোগাযোগ বেশি ছিল। সাগর-রুনির দাম্পত্য সমস্যাসহ কোনো প্রকার সমস্যার কথাই জানা নেই তাঁদের। অথচ সংবাদমাধ্যমে এগুলোও আজ প্রচার পাচ্ছে।


একইভাবে নিহত রুনির ভাই এবং মামলার বাদী নওশের আলম রোমান গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁদের হতাশা দিনদিন বাড়ছে। তাঁরা বিস্মিত যে আজ পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করা দূরে থাক হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণ সম্পর্কেও স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারছে না। পুলিশ তাঁদের কিছু জানাচ্ছেও না। তাঁরা যেটুকু জানছেন সেটা প্রচারমাধ্যম থেকেই।


গতকাল যখন রোমানের সঙ্গে কথা হয় তখন তিনি নিহত দম্পতির ছেলে শিশু মেঘকে নিয়ে বসুন্ধরা সিটিতে ঘুরতে ও খেলনা কিনতে গিয়েছিলেন। টেলিফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলার সময় রোমান বলেন, মেঘও তার মা-বাবাকে খুব 'মিস' করছে। তার অনেক কথারই উত্তর দিতে পারেন না তাঁরা।


এক প্রশ্নের জবাবে রোমান বলেন, এটা কখনোই চুরি বা ডাকাতিজনিত ঘটনা হতে পারে না। তাঁদের আশঙ্কা, কোনো মহল প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। এ ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি না করে তিনি প্রকৃত রহস্য দ্রুত উদ্ঘাটনের জন্য পুলিশের প্রতি আন্তরিক আহ্বান জানিয়ে বলেন, হতাশার কারণে তাঁর মাসহ পরিবারের প্রতিটি সদস্যই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন।


নিহত সাগর সরওয়ারের মা সালেহা মনির ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহের চেষ্টা চলছে বলে জোরালো আশঙ্কা প্রকাশ করে কালের কণ্ঠকে বলেন,' আমরা শুধু আসল ঘটনা জানতে চাই। খুনি কে, দেখতে চাই।' সালেহা মনির কান্নাজড়িত কণ্ঠে আরো বলেন, 'অনেক পত্রিকা যা খুশি তাই লিখছে। কিন্তু তোমরা (কালের কণ্ঠ) ভালোভাবে লিখছো। আজেবাজে কথা না লিখে প্রকৃত ঘটনা তোমরা বের করো। এখন তোমরা আমার সাগর। তোমাদের ভাইয়ের খুনিকে বের করো...।'


নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের সাবেক ওই আইজি কালের কণ্ঠকে আরো বলেন, 'আমি নিজেই মনে করি না এটা ডাকাতি বা চুরিজনিত খুন। চোর বা ডাকাত কাউকে হাত-পা বেঁধে খুন করবে না। অপরাধবিজ্ঞান বা অপরাধের চলমান ধরন মতে, এটা করার কথা নয়। এটা কোনো রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডও হতে পারে না। যতটুকু জানি, সাগর আর রুনি কোনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না। ফলে কোনো রাজনৈতিক চাপও পুলিশের ওপর থাকার কথা নয়। কিন্তু সেই রকম কথাও পত্রিকান্তরে প্রকাশ পাচ্ছে। আমি মনে করি না, কোনো দলের শীর্ষপর্যায় থেকে আসছে নির্বাচনকে সামনে রেখে এ ধরনের ঝুঁকি কেউ নেবে। এ অভিযোগ ঠিক নয় ধরে নিয়ে অন্তত এটুকু বিশ্বাস আর আস্থা রাখতে চাই। আর তাই আমি মনে করি, যদি সময়ও লাগে তবু একটি পরিপূর্ণ আর বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হওয়া উচিত। সেটা না হলে পুলিশ তাদের আস্থার অনেকটা জায়গা হারাবে।'

এ ব্যাপারে পুলিশের আইজি খন্দকার হাসান মাহমুদ কালের কণ্ঠকে বলেন, কে কোনটা বিশ্বাস করবে কি করবে না, সেটা তদন্তের বিষয় নয়। ওটা মাথায় রেখে তদন্ত করা যায় না। তদন্ত হচ্ছে প্রকৃত ঘটনা বা সত্যকে বের করে আনা। তদন্তে যদি প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটিত হয়, আর সেই সত্যটাও যদি বিশ্বাসযোগ্য না হয়, তখন কারই বা কি করার থাকে। সত্যকে মেনে নিতেই হবে।

আইজিপি আরো বলেন, এ ধরনের ঘটনা খুব একটা বেশি নয়, যেটা দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, সচিব, আইজিপি সার্বক্ষণিক তদারকি করেন। এ মামলার ক্ষেত্রে সেটাও করা হচ্ছে। ডিবির পাশাপাশি অন্য সংস্থাগুলোও এ ঘটনা নিয়ে তাদের মতো করে কাজ করছে। সবার একটাই উদ্দেশ্য, প্রকৃত সত্যকে খুঁজে বের করা। ফলে কারো মনে কোনো ধরনের সন্দেহ রাখার প্রয়োজন নেই। একটা আস্থার জায়গা তো মানুষের থাকতে হবে। তদন্তে যথেষ্ট অগ্রগতি আছে। আশা করা যাচ্ছে শিগগিরই এই জোড়া খুনের রহস্য উন্মোচন হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বলেন, পুলিশের ওপর যে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ আগে হয়নি, তা নয়। তবে এই সরকারের আমলে পুলিশ যতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে, এর আগে কখনো সেটা পারেনি। এ ধরনের ঘটনায় কারো কোনো চাপকে গ্রাহ্য করার প্রশ্নই ওঠে না। তবে হ্যাঁ, চাপ আছে। সেটা হচ্ছে প্রকৃত খুনিদের খুঁজে বের করা। এটা শুধু ঊর্ধ্বতন মহলের নয়, এটা বিবেক আর দায়িত্বেরও চাপ। আর সেই চাপেই পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হচ্ছে, তা ঠিক নয়। আসলে আসামি গ্রেপ্তার করতে দেরি হওয়ার কারণেই এসব অভিযোগ উঠছে। ভিত্তিহীন হলেও এই মুহূর্তে এটা অস্বাভাবিক নয়। আদালতের নির্দেশ থাকায় এখন তাঁরা ইচ্ছা থাকলেও আর কোনো প্রেস ব্রিফিং করতে পারছেন না। কারণ তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কোনো তথ্যকেই আক্ষরিক অর্থে নিশ্চিত বলা চলে না। ফলে প্রচারমাধ্যমের কর্মীরাও তাঁদের ভুল বুঝছেন। তবে এটা সত্য, এই জোড়া খুনের ঘটনা জটিল আর স্পর্শকাতর হওয়ার কারণে প্রত্যাশার চেয়ে তাঁদের অনেক বেশি সময় লাগছে। আর এতেই সাধারণের মনে অনেক সন্দেহ দানা বাঁধছে। রহস্য বের হলেই সব কিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে বলে তিনি জানান।

BY :  Parvez Khan.